এরশাদ বাদশার ডায়েরি

এরশাদ বাদশার ডায়েরি
এরশাদ বাদশার বাংলা ব্লগ

Friday, April 15, 2016

'বাবা'

এক

ফ্রাইংপ্যানে গরম তেলে ডিমটা ঢেলে দিতেই ছ্যাঁত করে খানিকটা তেল শিহাবের হাতে পড়লো। ফুটন্ত তেলের গরম ছোঁয়ায় সাথে সাথে ফোসকা পড়ে গেলো; 'উফ্!' যন্ত্রণায় অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে এলো শিহাবের মুখ দিয়ে।
'আব্বু, তুমি আসলে জানোনা কিভাবে ডিম ওমলেট করতে হয়।' হেসে বললো আরিয়ান, শিহাবের ছয় বছরের ছেলে। 


'আচ্ছা! তাহলে একসপ্তা ধরে কে তোকে ডিম ওমলেট করে খাওয়াচ্ছে?' কপট রাগ দেখিয়ে বললো শিহাব।
'খাওয়াচ্ছো ঠিকই, তবে প্রতিদিনই একটা না একটা অঘটন ঘটাচ্ছো।'
'কি রকম?'
'প্রথম দিন কি করলে? তেল গরম না হতেই ডিম ঢেলে দিলে। তারপরদিন ডিম ওল্টাতে গিয়ে পুরো ডিমেরই বারোটা বাজিয়ে দিলে। তারপরদিন ন্যাকড়া ছাড়া ফ্রাইংপ্যান নামাতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলে। তারপর......'


'চুপ করবি এবার? তুই যে তোর মায়ের মতো আমার প্রতিদিনকার কাজের হিসার রাখছিস সেটা তো আমার জানা ছিলোনা।' হেসে বললো শিহাব, খুব যত্নের সাথে ডিমটা উল্টে দিলো ও, যাতে ওটা অক্ষত থাকে।
'আচ্ছা, ঠিক আছে । তুমি শেষ করো, কার্বাডে অয়েন্টমেন্ট আছে, আমি নিয়ে আসছি।' বলে ভেতরে চলে গেলো আরিয়ান। ওর গমনপথের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শিহাব। 

রূপার যাবার পর আরিয়ানকে নিয়ে ওর চিন্তার অন্ত ছিলোনা। এতোটুকুন একটা ছেলেকে সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর ওর বিজনেস। ছেলেকে সময় দেবার মতো সময় বের করা ওর জন্য বেশ কঠিনই। বেশিদিন হয়নি, তিনবন্ধু মিলে একটা গার্মেন্টস খুলেছে। আগে একটা চাকরি করতো শিহাব, কিন্তু ওর অ্যামবিশন বিজনেস, তাই ও পথ থেকে সরে এসেছে। রাতদিন খাটছে, নিজেকে একজ্ন পারফেক্ট বিজনেসম্যান এবং মোটামুটি ধনী হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে।

শিহাবের মনে পড়ে সেই সব দিনগুলো। কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়েছিলো বন্ধুদের সাথে। সেখানেই পরিচয় রূপার সাথে। রোড অ্যাকসিডেন্টে বাবা-মা এবং একমাত্র ছোটভাই মারা যাবার পর দূর সম্পর্কের এক চাচার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলো ও। অনার্স পড়ছিলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে । শিহাবের সাথে পরিচয় ময়নামতিতে।  বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলো ও, একই উদ্দেশে শিহাবও। দেখা হলো, ব্যস প্রথম দেখাতেই প্রেম। শিহাব মনের মতো কাউকে খুঁজছিলো জীবন সাথি করার জন্য। রূপাকে পেয়ে আর দেরি করেনি। রূপার চাচাও যেন ওকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে।  চাচার বাসায়ই  বিয়েটা সারা হয়। শিহাবের দিক থেকে ওর বন্ধুরা উপস্থিত ছিলো। তারপর অপার সুখের দিনগুলো। শিহাব আর রূপা, রূপা আর শিহাব।
কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হলোনা সেই সুখ। কেন যে রূপা.....;  থাক; ওসব কথা ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হযনা। কিন্তু আরিয়ানের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। রূপা চলে গেছে আজ আটদিন। শিহাব উদ্বিগ্ন ছিলো আরিয়ান কিভাবে রিঅ্যাক্ট করে তাই নিয়ে। কারণ মার খুব ন্যাওটা ছিলো ছেলেটা। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সম্পূর্ণ শান্ত থাকলো আরিয়ান। এমনকি, একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলোনা মা কোথায় গেছে। তবুও শিহাব নিজে থেকে ওকে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। বলেছে- ওর আম্মু ওদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। কারণ আব্বুর সাথে ওর মনোমালিন্য চলছিলো অনেকদিন থেকে। তাই ওরা সেপারেট হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ব্যাখ্যাটা দেবার দরকার ছিলো। কারণ, শিহাব চায়না মার অনুপস্থিতিতি ওর কোমল মনে খারাপ কোন প্রভাব ফেলুক। ব্যাখ্যাটা মেনে নিয়েছে আরিয়ান। ওর রিঅ্যাকশনে যতোটা না অবাক হয়েছে শিহাব, তারচে' স্বস্তি পেয়েছে অনেক বেশি।
এমনিতে ওর ছেলে অন্য দশটা ছেলের থেকে আলাদা। রাগ, চিৎকার, চেঁচামেচি এসব ওর মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। বাড়তি আহ্লাদ করতে কোনদিনই দেখেনি ওকে শিহাব। ওর কেন যেন মনে হয়, আরিয়ান বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ক। এই জিনিসটা ওর মনে ভাবনার উদ্রেক করতো। তবে এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা ভাবনার চেয়ে স্বস্তিই দিচ্ছে বেশি।

ঠিকই বলেছে আরিয়ান, ওমলেটটা টিফিন-বক্সে ভরতে ভরতে ভাবলো শিহাব। আসলেই ওকে দিয়ে এসব কাজ হবার নয়। চিন্তা করে অবাক হতে হয়। রূপা কি করে যে সব কাজ সামলাতো!
একটা বুয়া রেখে দিতে হবে, এটাই সবদিক থেকে ভালো হয়।
'আব্বু তোমার হলো?' ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই প্রশ্ন করলো আরিয়ান।
'হ্যাঁ, বাবা। তুই এখনো কাপড় পরিসনি?'
'পরবো। আগে তোমার হাতে মলম লাগিয়ে দেই। কই, দেখি- হাতটা দাও।'
ওর হাতে যখন মলম লাগাচ্ছিলো আরিয়ান, শিহাব তখন নিকট অতীতে ফিরে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো আরিয়ান নয়, রূপাই ওর হাতে মলম লাগাচ্ছে। মা-ছেলের মধ্যে এতো মিল।
'আরি' ছেলেকে ডাকলো শিহাব।
জি, বাবা।'
'তোর, মার কথা মনে পড়েনা?'
'পড়বেনা কেন, পড়েতো।' মৃদু স্বরে উত্তর দিলো আরিয়ান।
'মা'র কাছে যেতে ইচ্ছে করেনা?'
'হ্যাঁ।, তবে আমি জানি, মার কাছে চাইলেও যাওয়া যাবেনা। মাতো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে; তাইনা আব্বু?'
'হ্যাঁ, বাবা। ওকে আমাদের ভুলে যাওয়াই ভালো, কি বলিস?' ছলছল চোখে বললো শিহাব।
'হ্যাঁ; আচ্ছা চলোতো, আমাকে কাপড় পরিয়ে দাও। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর তুমিতো এখনো শেভ করোনি। আমাকে দিয়ে আসবেনা?'
'তোকে নামিয়ে দিয়ে এসে তারপর আমি রেডি হবো।'
'তাহলে চলো।'
'হ্যাঁ, চল।'

দুই

স্কুল ছুটির পর প্লে-গ্রাউন্ডে এককোনায় বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে আরিয়ান। আম্মু যখন ছিলো তখন অপেক্ষা করতে হতোনা। বরং আম্মুই ওর জন্য অপেক্ষা করতো। ছুটির আগেই এসে পড়তো। আব্বুর অনেক কাজ; আরিয়ান জানে। সবকিছু ম্যানেজ করে আসতে তার প্রতিদিনই বিশ মিনিট বা আধঘন্টার মতো লেট হয়ে যায়। আর এ সময়টাই ভাবনার জন্য কাজে লাগায় সে।
হ্যাঁ, আরিয়ান ভাবে। অনেককিছুই ভাবে। ভাবে ওদের সুখের দিনগুলো। আব্বু-আম্মু আর সে। কেমন করে যে আব্বু-আম্মুর মধ্যে খুব খারাপ একটা ভাইরাস ঢুকে পড়লো, ভেবে পায়না আরিয়ান।
ওর মনে পড়ে আব্বু-আম্মুর মধ্যে ঝগড়ার দিনগুলো। ওই ক্ষণগুলোতে দারুন অস্বস্তি বোধ করতো সে। ওর ইচ্ছে করতো তাদের দুজনের কাছে আগের সেই সুখের দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে।
কোনো কোনোদিন ঝগড়া মারাত্মক আকার ধারণ করতো। সেই সময় আব্বু আম্মুর গায়ে হাত তুলতো। আরিয়ান আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদতো। কখনও ঝগড়ার সময় মাঝখানে যেতোনা।
আম্মুকে সান্তনা দিতো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিতো। আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো।
আব্বু-আম্মুর মধ্যে ঝগড়া কি নিয়ে ও জানতো। একদিন আম্মুকে বলতে শুনেছে।
আরিয়ান ভাবে সেই দিনের, কথা যেদিন আম্মু চলে গেলো। সেদিন স্কুলে থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসছিলো সে। আসার কথা ছিলোনা। ওদের এক টিচার হঠাৎ করে মারা যাওয়াতে স্কুল ছুটি দেওয়া হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব স্টুডেন্ট এর অভিভাবকদের ফোন করে জানিয়ে দেয় তাদের সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরিয়ানদের ওখানেও করা হয়। কিন্তু ওদের বাসার ফোন কেউ রিসিভ না করায় তারা আরিয়ানকে পেীঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
ট্যাক্সি ক্যাবে করে স্কুলের পিয়ন ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। আরিয়ান বাসায় ঢুকেই বুঝতে পারে বাসার অবস্থা থমথমে। সে পায়ে পায়ে আব্বু-আম্মুর রুমের দরোজায় গিয়ে দাঁড়ায়। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দারুণ উত্তেজিত দুটি মানুষের উত্তপ্ত বাক্যবাণ।
তারপর একদম অপ্রত্যাশিতভাবেই ঘটে যায় ব্যাপারটা। আরিয়ান বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো ঘটনাটা অবলোকন করে।
আরিয়ান দেখে, আব্বু আম্মুর মাথা দেয়ালের সাথে প্রচন্ড জোরে জোরে ঠুকতে থাকে। আম্মু অনেক চেষ্টা করেও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি। এভাবেই আম্মুকে মেরে ফেলে আব্বু। আরিয়ান জানে, আব্বুর সাথে একটা মহিলার সম্পর্ক আছে। যার জন্য মরতে হলো আম্মুকে।
আরিয়ানের কোমল হৃদয় ভেঙে চুর হয়ে যায় এই নির্মমতা দেখে। তারপরও কোন এক অদৃশ্য শক্তির বলে সে ওখান থেকে সরে আসতে পারেনা। লুকিয়ে দেখতে থাকে আব্বু নামের সেই পাষন্ডের বর্বরতা। আম্মুকে পরীক্ষা করে আব্বু বুঝতে পারে আম্মু মারা গেছে। তারপর খুব ঠান্ডা মাথায় ডেডবডিটা ঢুকিয়ে দেয় ফ্রিজের মধ্যে। ওদের ফ্রিজটা অনেক বড়ো। অনায়াসে আম্মুর হালকা শরীরটা জায়গা করে নেয় ওটার মধ্যে। তারপর একটা ভিজে তোয়ালে দিয়ে দেয়াল এবং মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রক্তের ধারা মুছে ফেলে সযত্নেœ। আধঘন্টার মধ্যে খুনের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে। আরিয়ান লুকিয়ে প্রত্যক্ষ করে সমস্ত কিছু। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে যায় সে।
নিজেকে সাহস যুগিয়ে, মনকে শক্ত করে আরিয়ান। সিদ্ধান্ত নেয় কোনোমতেই আব্বুকে বুঝতে দেয়া চলবেনা যে, সে সবকিছু দেখে ফেলেছে।
আব্বু ওকে দেখে জড়িয়ে ধরে, বলে-'আরি, বাবা কি ব্যাপার? কখন এলি?'
আরিয়ান তখন বাবাকে বলে কেন সে স্কুল থেকে চলে এসেছে। বাবাকে বুঝতে দেয়না যে সে আম্মুর খুনের প্রত্যক্ষদর্শী।
সারাটা দিন আব্বু ওর কাছে থেকেছে। আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করেনি আরিয়ান। আব্বু নিজেই বললো যে আম্মু আব্বুকে ডির্ভোস দিয়ে চলে গেছে। আরিয়ান কোনো কথা বলেনি।
রাতে বিছানায় ওকে ঘুম পাড়ায় আব্বু। আরিয়ান ঘুমের অভিনয় করে। তারপর গভীর রাতে আব্বু আম্মুর লাশটা ফ্রিজ থেকে বের করে তেরপল দিয়ে বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আরিয়ান লুকিয়ে দেখে সব। অনুমান করে হয়তো কোন খাদে অথবা নর্দমায় নয়তো নদীতে ফেলে দিয়ে ফেরত আসে আব্বু।
এরপর আব্বু যতোবার ওকে আদর করেছে ততোবারই ঘৃণায় রি রি করে উঠেছে ওর ছোট্ট শরীরটা। কিন্তু কখনও আব্বুকে বুঝতে দেয়নি ওর ঘৃণা।

আরিয়ান প্রতিদিন ভাবে কি করে সে ঘটনাটা ঘটাবে। স্কুল ছুটির পর এই সাতদিনের অপেক্ষার প্রতিটি প্রহর তার মাথায় ঘুরেফিরে ওই চিন্তাই বারবার এসেছে । কি করে খুন করবে বাবাকে। হ্যাঁ, প্রতিশোধ নেবে সে, অবশ্যই।
কাজটা কিভাবে করবে ভেবেও রেখেছে সে। ইঁদুর মারার বিষ এনেছিলো আম্মু একবার। ওটা কোথায় আছে সে জানে। খাবারের সাথে বা চায়ের সাথে কায়দামতো মিশিয়ে দিলেই হলো। ওকে কেউ সন্দেহ করবেনা, জানে সে। ওর মতো ছোট্ট ছেলের পক্ষে এ ধরনের কিছু করা কল্পনাতীত।

পারবে সে। আব্বু যেমন কাউকে কিছু জানতে দেয়নি, ঠিক তেমন আব্বুর মৃত্যুর পিছনে কার হাত আছে কেউ জানবেনা ।

ওই যে, আব্বু আসছে। অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হলো আরিয়ান। এখন ওই পাষন্ডটাকে চুমু খেতে হবে ওকে।
                     
                          *******

No comments: