এরশাদ বাদশার ডায়েরি

এরশাদ বাদশার ডায়েরি
এরশাদ বাদশার বাংলা ব্লগ

Friday, April 15, 2016

সহযাত্রী

বাসে উঠতেই মন অনেকটা হালকা হয়ে গেলো। উফ, কি ঝামেলাটাই না গেছে। মতিঝিল থেকে চট্টগ্রামের বাস টার্মিনাল, লম্বা জার্নি। ধকলটা খুব জবরই গেছে বলতে হবে।
সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর নীল টাই পরা সুপারভাইজার আমাকে সিট দেখিয়ে দিলো। মাঝখানে জানালার পাশে আমার সিট। দারুণ স্বস্তি অনুভব করলাম, কারন- আরো অনেকের মতো জানালার পাশের সিটটা আমার প্রিয়। আর লম্বা জার্নির জন্য এতো সোনায় সোহাগা।

ব্যাগটা মাথার উপরের র‌্যাকে রেখে আয়েশ করে বসলাম সিটে। বাস ছাড়তে মনে হয়ে এখনো দেরি আছে। ক্লান্ত শরীরে আরামের ছোঁয়া লাগতেই দু'চোখ বুঁজে এলো। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।

আসার কথা ছিলো সবারই। রোহান, রিফাত, আরজু এবং আসিফ। প্ল্যানটাও ছিলো জবরদস্ত। প্রথমে ঢাকা থেকে সোজা কক্সবাজার, সেখান থেকে হিমছড়ি তারপর সোজা সেন্টমার্টিনস। পুরো প্রোগ্রামটা সেলুলয়েডে বন্দি করার জন্য হ্যান্ড ক্যামেরা, মানে মুভি ক্যামেরাও যোগাড় করা হয়েছিলো। আরজুর ছোটমামার আমেরিকা থেকে পাঠানো সেই ক্যামেরাটি যথোপযুক্ত ব্যাবহারের জন্য সে ওটি দান করেছিলো।
তারপর সেন্টমার্টিনের বালুর চরে ক্যাম্পিং এর মজা লোটার জন্য তাঁবুও কেনা হয়েছিলো। এমনকি বাসের টিকিট পর্যন্ত বুক করা হয়েছিলো। মোদ্দা কথা, আয়োজনের চুড়ান্ত করা হয়েছিলো। তবে এ সবকিছুই যে ধোঁকা দেয়ার পাঁয়তারা, তা একবারের জন্যও আমার মাথায় আসেনি।
এটাকে আমরা, মানে আমাদের সার্কেলে বলা হয় ছ্যাঁক; যেমন একবার রিফাতকে খাওয়ানো হয়েছিলো। বেচারা রিফাত; মনে পড়তেই আমার আপনাতেই হাসি চলে এলো।
আসলে হয়েছিলো কি- রিফাত একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। আমাদের কলজেরই, নাম নেহা। তবে নেহা ভালোবাসতো অলক নামে আরেকজনকে। ট্রায়াঙ্গল লাভ আর কি, এক ফুল দো মালি টাই।
চিঠি, এসএমএস, ইমেইল ইত্যাদির মাধ্যমে রিফাত নেহাকে ভালোবাসার কথা জানায়। কিন্তু কোন সাড়া পায়না । ওর সেই নীরবতার সুযোগটাই নেই আমরা।
পুরো প্ল্যানটা ওকে খুলে বলা হয়। প্রথমে ও রাজী হতে চায়নি। আমাদের চাপাচাপিতে হতে বাধ্য হয়। আমরা ওকে বলি, ওকে কিছুই করতে হবেনা, সেই বিজ্ঞাপনটার মতো; শুধু একটা ফোন, ব্যাস। বাকি কাজটুকু আমরাই করবো।
পরিকল্পনা মোতাবেক নেহা ওকে ফোনে জানায়- সে রিফাতের সাথে দেখা করতে চায়। অমুক তারিখ অমুক সময় অমুক স্থানে ও যেন নেহার জন্য অপেক্ষা করে।
মজনু সাহেব প্রায় উড়তে উড়তে আমাদের কাছে এলেন, খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে তিনি আমাদের জানালেন ফোনের কথা। বেচারা তখন ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে।
তাকে আমরা নানা শলা-(কু)পরামর্শ দিলাম ডেটিং এর ব্যাপারে। তার মধ্যে একটা ছিলো ওর পোষাকের ব্যাপারে। আগেই ঠিক করা হয়েছিলো ওকে ব্লেজার পরতে বলা হবে। যেহেতু সময়টা ছিলো গ্রীষ্মকাল আর দেখা করার সময়টা ছিলো ভর দুপুর।
প্রেমিকপ্রবর নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা আগেই ফুল সমেত স্পটে হাজির। গাছ-গাছালি বিহীন পিচগলা রোদের মধ্যে ব্লেজার গায়ে যখন ঘেমে ও গোসল করছিলো আড়ালে দাঁড়িয়ে তখন হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ছি আমরা।
প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবে ঝুলিয়ে রাখার পর আমরা ওকে মুক্তি দিলাম। আমাদের দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলো ও। এরপর প্রায় দু'মাস আমাদের সাথে কথা বলেনি রিফাত।

অনেকদিন পর আবার সেই ছ্যাঁকটা আমাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়, এবং সেটা এই বেড়ানোর প্ল্যানকে কেন্দ্র করে। অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেও যখন আমাকে ধোঁকা দেওয়া গেলোনা তখন এই সফরের পরিকল্পনা করা হয়। কারণ ওরা জানে ট্রাভেলিং এর প্রতি আমার দুর্বলতা খুব বেশি।
পিঠে প্রমাণ সাইজের ব্যাগ, পরনে ধোপ-ধোরস্ত পোষাক, চোখে সানগ্লাস এবং কাঁধে ক্যামেরা; পুরোপুরি টুরিস্ট বনে যখন আরজুদের বাসায় সবার সাথে মিলিত হতে গেলাম তখন ওদের দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! সবাই আয়েশ করে বসে খালাম্মার হাতে বানানো পিঠা খাচ্ছে এবং টিভিতে ক্লোজ-আপ ওয়ান প্রোগ্রাম দেখছে।
আমাকে ওই অবস্থায় দেখে হাসির ফোয়ারা বইয়ে দিলো ওরা। তখনই বুঝতে পারলাম মদন এবার আমাকেই বানানো হয়েছে। কিন্তু আমি চিরকালই জেদি; আমার অহমে ভীষণ আঘাত লাগলো। আরজুর হাত থেকে টিকিট ছিনিয়ে নিলাম এবং বললাম-'খুব মজা করা হচ্ছে, না? ভাবছিস ছ্যাঁকটা খুব জবরদস্ত হয়েছে, তাইনা?
তাহলে শোন- কোন ছ্যাঁক-ট্যাক এর ধার ধারিনা আমি। আমি কক্সবাজার যাচ্ছি এবং আজই!
আমার ঘোষণা শুনে সবার মুখ কালো হয়ে গেলো।
'কি, কেমন লাগছে এবার? নিশ্চয়ই ভাবতে পারিসনি যে আমি একাই রওয়ানা হবো। ধরে নে, ছ্যাঁকটা আমিই তোদের খাওয়ালাম।' হাসতে হাসতে বললাম।
সবাই আমাকে বোঝাতে চাইলো যে, এটা আমার অন্যায়, নিয়ম অনুযায়ী আমার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া উচিত। যখন কোনমতেই আমাকে বোঝানো গেলোনা, তখন ওরাও আসতে চাইলো আমার সাথে। কিন্তু তখন আমার মাথায় ছ্যাঁকটা ওদেরকেই ফেরত দেবার চিন্তা। তাই কারো কথা না শুনে সোজা রওনা দিলাম, বললাম-'খবরদার কেউ যেন আমার সাথে না আসে।' যাওয়ার সময় পিছন ফিরে ওদেরকে দেখেছিলাম; যা হয়েছিলো না এক একটার চেহারা, দেখে দারুণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম!
কিন্তু সেই তৃপ্তিটা এখন পরিণত হয়েছে আফসোসে। একা একা জার্নি করে ভীষণ বোরিং ফিল করছি আমি। আর তাতে করে একাকী বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে তার একটা ধারণা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি ।


চোখে তন্দ্রামতো এসছিলো, টুটে গেলো খুব দারুণ একটা পারফিউমের সুগন্ধে। চোখ মেলে পাশ ফিরতেই পুলকিত হলাম। পাশে সুন্দরী! না,না, সুন্দরী নাকি বান্দরী তা এখনো জানিনা। তবে আমার সহযাত্রী যে একটা মেয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মুখের সামনে একটা ম্যাগাজিন ধরে আছে, তাই মুখটা অদৃশ্য। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম, যাক, অন্তত বাস জার্নিটা বোরিং হবেনা। আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস শতভাগ; জানি, ওর সাথে ভাব জমাতে আমার খুব একটা সময় লাগবেনা।
বাস ইতিমধ্যে যাত্রা শুরু করেছে; শহরের ব্যস্ত রাজপথে নিজের জায়গা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত। আর আমি চেষ্টায় রত সহযাত্রীর মুখ দর্শনের। কিন্তু খানিক চেষ্টার পরও যখন ম্যাগাজিনটা মুখের উপর থেকে সরালোনা মেয়েটা, হতাশ বোধ করলাম। উপযাচক হয়ে কথা বলা ছাড়া উপায় দেখছিনা। আর এ কাজটা আমার একেবারেই না পছন্দ। কারণ আমি জানি মেয়েরা এ ধরনের ছেলেদের পছন্দ করেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম আরো খানিক দেখি।
উঁকি-ঝুঁকি মেরে মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হয়ে ক্ষান্ত দিলাম, কারণ এভাবে তাকানোটা অভদ্রতা। রাগও হলো, মেয়েটা কি পণ করেছে গোটা সফরটা এভাবে মুখের উপর ম্যাগাজিন ধরেই কাটিয়ে দেবে!

এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলো, সহযাত্রীর মুখ দর্শনে ব্যর্থ আমি বিফল মনোরথ হয়ে জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম। বাস শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় এসে পড়েছে। ভালোই লাগছিলো সবুজ বন-বনানী, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। বাস যখন তুমুল গতিতে ছুটে চলছিলো ক্ষেতের পর ক্ষেত, গ্রামের পর গ্রাম পিছনে রেখে যাচ্ছিলো। একটা অন্যরকম অনুভুতি, আমার ভিতরে গুঞ্জরিত হতে লাগলো। একেবারে বিভোর হয়ে গেলাম দেখতে দেখতে।
ঘোর ভাঙল সুরেলা একটি মেয়েলি কন্ঠে-'আপনার কাছে কি লাইটার হবে?' সুরের ঝংকার তুলে বলছিলো সেই কন্ঠটি। চমকে পিছন ফিরতেই দেখতে পেলাম সেই কোকিল কন্ঠী আর কেউ নয়, আমার সহযাত্রীই! দারুণ পুলকিত হলাম, অবশেষে শিকে ছিঁড়লো তাহলে!
মনে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো; ইচ্ছে হলো খুশিতে বগল বাজাই। কারণ- যেমন মেয়েটার কন্ঠ ঠিক তেমনি ওর চেহারা। কোমল, স্নিগ্ধ, লাবণ্যময়। নারী সবসময় আকর্ষণীয়, অবশ্য যদি সে সুন্দর চেহারার অধিকারী হয়। কোন কোন নারীর চেহারায় এমন কিছু আছে যা পুরুষকে মাতোযারা করে দেয়। আর কারো চেহারায় কাশফুলের স্নিগ্ধতা, নদীর গভীরতা আর চাঁদের সৌন্দর্য বিরাজ করে। বিধাতা সেই সব নারীদের সময় নিয়ে সৃষ্টি করেন। আর বলাই বাহুল্য আমার পাশের জন সেই সব সৌভাগ্যবতীদের একজন। কেন যেন মনে হলো মেয়েটা আমার অনেক দিনের চেনা, কোথায় যেন দেখেছি ওকে। কিন্তু···, কোথায় দেখেছি?
ভালো করে চেষ্টা করতে মনে পড়লো কোথায় দেখেছি। বাস্তবে নয়, ফিল্মে । খুব ছোটবেলায় একটা হিন্দি ছবি দেখেছিলাম, সেই ছবির নায়িকার চেহারা হুবহু এর মতো। মতো নয়, মনে হচ্ছে ওই। এতোটাই মিল দুজনের চেহারায়। সেই ছোট্টবেলায় দেখা নায়িকার ছবি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিলো । কারণ মেয়েটার চেহারাই ছিলো ওরকম। কি যেন নাম ছিলো সেই নায়িকার? এই দেখ, সবসময় ছবি আর ছবির নায়িকার নাম আমার মাথার মধ্যেই থাকে; অথচ এখন চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনা।
ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করছিলাম, ঘোর ভাঙল মায়াবতীর ডাকে,- 'এই যে, আপনাকেই বলছি, আপনার কাছে কি লাইটার হবে?'
কি যেন বলছিলো মেয়েটা? ও হ্যাঁ, লাইটার। লাইটার? ভাবতেই কেমন যেন বোধ করলাম, এতো কিছু থাকতে লাইটার! এরচে' আমার মোবাইলটা চাইলে কতোইনা খুশি হতাম। চারদিন আগে কিনেছি, চমত্কার ডিজাইন।
কিন্তু অপ্সরী লাইটার দিয়ে কি করবে। কি আর করবে হাঁদারাম! নিজেকে গালি দিলাম। এই বাসের মধ্যে নিশ্চয়ই চুলা জ্বালাবেনা। তাহলে? তাহলে আর কি, সিগারেটই ধরাবে। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো আমার, এই অপ্সরী খাবে সিগারেট! এতে এতো আশ্চর্য হবার কি আছে? মর্ডান মেয়েদের চাল-চলনে পশ্চিমা সংস্কৃতি যেভাবে প্রভাব ফেলছে, শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ ওয়ার্ডরোবে স্যুভেনির হিসেবে রেখে স্কার্ট আর জিনস নিয়ে যেভাবে মেতে উঠেছে, তাতে করে বাঙালী মেয়েদের ঠোঁটে সিগারেট তেমন বিচিত্র কিছু নয়; নিজেকে প্রবোধ দিলাম, তবে মনে মনে মেনে নিতে পারলাম না ব্যাখ্যাটা। কারণ এর পরনে সালোয়ার কামিজই, আর আগেই বলেছি একে দেখলে মনে প্রশান্তির ভাব জাগে, এর মুখে আর যাই হোক সিগারেট মানায়না।
কিন্তু মায়াবতী আমার কাছে কিছু চেয়েছে, তা সে যাই হোক না কেন। কিন্তু যেটা চেয়েছে সেটা আমার কাছে নেই। থাকার প্রশ্নই আসেনা, কারণ আমি সিগারেট খাইনা। বলতে গেলাম যে-'সরি, আমার কাছে লাইটার নেই।' পারলামনা, মুখের আগায় এসে আটকে গেলো কথাটা। কেন যেন মনে হলো এর কাছে নেই বলে কোন শব্দ উচ্চারণ করা যাবেনা। এ যা চায় তাই ওকে দিতে হবে। যদি বলে আকাশ থেকে এক্ষুনি চাঁদটা পেড়ে দিতে হবে, তাহলেও পিছু হটা যাবেনা। আকাশে উঠার জন্য মইয়ের সন্ধানে লেগে যেতে হবে। কেন এমন মনে হলো, আমি নিজেই জানিনা।
এরপর হাস্যকর একটা কাজ শুরু করলাম আমি। যা নেই তাই খুঁজতে শুরু করে দিলাম। উপরের র‌্যাক থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ওটা হাতাতে শুরু করে দিলাম। আমি জানি নেই, তবু খুঁজছি। খুঁজতেই খুঁজতেই নিজেকে গাল দিচ্ছি-গাধা! বোকা! মদন! গর্দভ! সাথে সাথে বলে দিলে কি হতো, যে তুই সিগারেট খাসনা, তাতে তোর ইজ্জত বাড়তো বৈ কমতোনা। এখন ক্যবলাকান্তের মতো মুখ করে বলতে হবে- দুঃখিত, আমার কাছে লাইটার নেই। মেয়েটা তখন ভাববে কি? আর যাই হোক, তুই যে স্মার্ট নোস, সেটা অন্তুত বুঝতে পারবে।
কিন্তু আমার ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন, আমাকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগের কোনা থেকে উঠে এলো একটি সুদৃশ্য লাইটার। ওটা একটা ফ্ল্যাট লাইটার, তিনটি বটম আছে এর গায়ে। লাল রঙের বটম টিপলে আগুন বের হয়, নীল রঙেরটা টিপলে কলমের নিব, আর সবুজ রঙেরটা টিপলে খুব সুন্দর একটা মিউজিক বাজে। ওটা ছোটমামা সিঙ্গাপুর থেকে বাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই জিনিস কি করে আমার ব্যাগে এলো সেটা আমার মাথায় এলোনা।
যাইহোক, মাথায় আমি আনতেও চাইলামনা। পাওয়া গেছে, মেয়েটাকে দিতে পেরেছি, এতেই আমি খুশি। আর অপ্সরীকে ধন্যবাদ, সেই সাথে খোদাকেও। কারণ- মেয়েটা লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালোনা। ওর কামিজের এক কোনার একটা সুতো উঠে গিয়েছিলো, সেটাকে পোড়ানোর জন্যই।
'ধন্যবাদ। এটা না পোড়ালে এর সাথে সাথে আরো উঠে যেতো।' কাজ শেষ হলে লাইটার ফেরত দেবার সময় ব্যাখ্যা দেবার সুরে বললো ও। তারপর আবার মুখের উপর ম্যাগাজিন ধরলো।
লে হালুয়া, ভাবলাম, এর সমস্যাটা কি? আর বাংলাদেশের পত্রিকা জগতের উপরও সীমাহীন রাগ হলো। ফকির দেশে আমিরি চাল, আরে বাবা, যে দেশের মানুষ দু' বেলা দু' মুঠো ভাত খেতে পারেনা, তারা এতোগুলো পত্রিকা দিয়ে করবেটা কি?

কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেলো। মনটা উস-খুশ করতে লাগলো ওর সাথে কথা বলার জন্য। এবার লজ্জার মুখে লাথি মেরে নিজেই নীরবতা ভাঙলাম। বললাম-'মাফ করবেন, আমরা পাশাপাশি বসে সফর করছি, নিশ্চয়ই আমাদের পরিচিত হওয়া উচিত, কি বলেন?'
'জি, নিশ্চয়ই। আমি হেনা।' অপ্সরী নাম বললো, সাথে সাথে আমার মনে পড়লো কেন মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো। যে ছবির কথা বলেছিলাম, সেই ছবির নাম ছিলো হেনা, আর এর নাম ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন জেবা বখতিয়ার নামে এক পাকিস্তানী অভিনেত্রী। যার সাথে এর চেহারার বিস্তর মিল।
'আমি জয়, জয় আহমেদ। ঢাকার মতিঝিলে আমার বাড়ি।'
'আমার বাড়ি চিটাগাঙেই। এই বাস প্রথম যেখানে থামবে সেই আমিরাবাদেই। সেখান থেকে আধঘন্টার পথ।'
'কিন্তু আপনি...'····
'হ্যাঁ, আমি টাউন থেকে আসছি। আগ্রাবাদে আমার খালার বাড়ি, ওখানেই থাকি আমি, পড়াশোনা ওখানে থেকেই করছি। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি মাকে দেখতে।'
'ও, আচ্ছা; আমার উদ্দেশ্য বেড়ানো।' তারপর বেড়ানোর প্ল্যান থেকে শুরু করে ছ্যাঁক, এবং পরে আমার একলা চলা, সবকিছুই খুলে বললাম ওকে। প্রথমে ও হাসলো, তারপর বললো- এভাবে আমার একা বের হওয়া উচিত হয়নি। কারণ জিজ্ঞেস করতে ও বললো- আর যাই হোক বেড়াতে হলো অন্তত দু'জন হওয়া চাই। আমার বলতে ইচ্ছা করলো- চলুন না আমার সাথে, আপনি গেলে তো দুজন হচ্ছিই। কিন্তু বলা হলোনা।
ও ছ্যাঁকের ব্যাপারটা জানতে চাইলো। বললাম ওকে আমাদের সার্কেলে ছ্যাঁক এর মাজেজা কি। রিফাতের ঘটনাটা খুলে বলাতে ওর তো হাসিতে দম ফাটার অবস্থা। আমি বিভোর হয়ে দেখতে লাগলাম নদীর বিভিন্ন রুপ। ও যখন মুচকি হাসে তখন মনে হয় নদীতে মৃদুমন্দ ঢেউ উঠছে, আর যখন উত্তাল হাসি ওর সারা শরীরে হিল্লোল তুলে, তখন মনে হয় নদীতে ঝড় উঠেছে। তবে সে ঝড় কোনো লোকালয় উড়িয়ে নিয়ে যায়না, এক অন্যরকম, মধুর তরঙ্গের সৃষ্টি করে। যার সাথে এই প্রথম আমি পরিচিত হলাম।
ওর সহানুভুতিশীল মনেরও পরিচয় পেলাম যখন ও বললো- রিফাতের সাথে আমরা কাজটা অন্যায় করেছি। ওর সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করাটা আমাদের মোটেও উচিত হয়নি।

এরপর আর কথা বলার সাবজেক্ট খুঁজে পেলামনা। কিছুক্ষণ নীরবেই কেটে গেলো। তারপর আমাদের বাস থেমে গেলো। সুপারভাইজার জানালো যে- পথের এই বিরতিতে যাত্রী সাধারণ চাইলে কিছু খেয়ে নিতে পারেন। খাওয়ার কথা বলতেই বুঝতে পারলাম আমার পেটের ভেতর ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়েছে।
'চলুন,হেনা, কিছু খেয়ে নেয়া যাক।' অফার করলাম ওকে।
'না, ধন্যবাদ। আমিরাবাদ প্রায় এসে পড়েছে। আমি বাড়িতে গিয়েই খেয়ে নেব।'
কারো উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া আমার স্বভাব নয়। তাই কিছু বললাম না আর। নেমে গেলাম।
জায়গাটা মফস্বলের মতো। মোটামুটি জমজমাট। ভালো একটা হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম। পরোটা আর ভাজা মাংস দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। যাওয়ার সময় হেনার জন্যও পার্সেল নিয়ে গেলাম।
ও নিতে চাইলোনা, জোর করে গছালাম।
আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো। হেনার দিকে তাকালাম, ওকে কিছুটা বিষণ্ণ দেখালো। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। থাক না, বেশি আদিখ্যেতা দেখানো হয়ে যাবে। তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারলাম না, মনে হলো যতোটা সময় ওর সাথে কাটানো য়ায়, ঠিক ততোটুকুই লাভ।
'আপনার গন্তব্যস্থল আর কতোদুরে?'
'বেশি না, ধরুন পনেরো মিনিট।'
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আর মাত্র পনেরো মিনিট ওর সাথে আছি আমি। নিজের কাছেই বিসদৃশ্ ঠেকলো ব্যাপারটা। এই স্বল্প পরিচয়েই এতোটা দুর্বল হয়ে পড়েছি আমি ওর প্রতি। কোনোকালেই এরকম ছিলাম না আমি। কতো নারীই তো তার ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো; কই, কখনো তো এরকম আকর্ষণ বোধ করিনি। কেন মনে হচ্ছে এই অপরিচিতাইকেই খুঁজে বেড়িয়েছে আমার অবচেতন মন। মনে মনে ওকে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে দিলাম- ওর কাছে জেবাও নস্যি। বেহুদাই এতোদিন মটু, মানে আদনান সামীর উপর রাগ করে ছিলাম- এতো সুন্দর একটা মেয়েকে ডির্ভোস করেছিলো বলে। মুটু যদি হেনাকে দেখতো, তাহলে ডিভোর্সটা অনেক আগেই দিয়ে দিতো।
নয়শো সেকেন্ড, মানে পনেরো মিনিট। এতো অল্প সময়, কোনদিক দিয়ে যে চলে গেলো টেরই পেলামনা। হেনার দিকে তাকালাম, দেখলাম, ও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমিরাবাদে যাত্রা বিরতি ঘোষণা করলো সুপারভাইজার। হেনা বললো-'যাওয়ার সময় হলো। আপনার কথা মনে থাকবে আমার।'
আর এখন থেকে চব্বিশ ঘন্টা শুধু তোমার কথাই ভাববে আমার মন, মনে মনে বললাম আমি। মুখে বললাম-'ঠিক আছে, যান, যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে আবার দেখা হবে।'
হেনা নেমে গেলো। বাস থেকে নেমে ফুটপাত ধরে চলতে লাগলো, হঠাৎ দেখলাম ও পিছন ফিরলো, তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে আসতে লাগলো। আমি নেমে পড়লাম বাস থেকে। হেনা দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর আমি ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম।
'স্যার, আমরা এখানে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতি নিচ্ছি, লাঞ্চটা এখানেই সেরে নিতে পারেন।'
সুপারভাইজারের কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। এতোক্ষণ কল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছিলাম, আসলে হেনা যাওয়ার সময় একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকায়নি। তাকানোর কথাও নয়, এগুলো ফিল্মে হয়। আর বেশি বেশি হিন্দি ফিল্ম দেখে আমার মাথাও আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে।
আবার কবে হেনাকে দেখবো, আদৌ দেখবো কিনা সেই চিন্তায় মাথায় ঘুরতে লাগলো। এবং তখনই মনে পড়লো মনে করে হেনার মোবাইল নাম্বারটাও নেওয়া হয়নি। আরো একবার নিজেকে বেকুব বলে গাল দিলাম। হয়তো আর কখনও ওর সাথে দেখা হবেনা, এই ভাবনাটা আমাকে বিচলিত করে দিলো।

বিরতি শেষে বাস আবার তার গন্তব্যে ছুটতে লাগলো। আমার তখন কিছুই ভালো লাগছেনা, মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছে, হেনা। কেন যে ওর সাথে দেখা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার এর লালদিঘির পাড়ে। বাস শেষবারের মতো পার্ক করলো ড্রাইভার। যাত্রীরা সবাই নামার তোড়জোড় শুরু করে দিলো।

বাস থেকে নামতেই সমুদ্রের কোমল হাওয়া এসে মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। মনে হলো খুব একটা বোরিং হবেনা নিশ্চয়ই সফর।
সোজা হোটেলের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। রিকশায় করে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মোটেল সৈকতে। বীচের খুব কাছেই হোটেলটি। রিসেপশনে নাম-ধাম লিখে চাবি নিয়ে লিফটে করে রুমে ঢুকলাম।
তারপর কোনোমতে কাপড় ছেড়ে সোজা বাথরুমে। কমসে কম আধঘন্টার আগে বেরুচ্ছিনা, সারা শরীরে নোংরায় গিজগিজ করছে।
পুরু গদি আঁটা নরম বিছানায় লম্বা হতেই দুচোখ বুজে আসতে চাইলো ঘুমে। পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও রুম সার্ভিসকে ডাকতে ইচ্ছে হলোনা। আগে ঘুম তারপর খাওয়া, ভেবে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।


লম্বা ঘুম দেয়াতে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগলো। সেই সাথে পেটের ভেতর সুপ্ত হয়ে থাকা খিদেটা বেশ চাগিয়ে উঠলো। ইন্টারকমে রুম সার্ভিসকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিলাম।
খাবারের মেনুটা বেশ। সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ, মুগের ডাল, তার সাথে আলুর ভর্তা; পুরোপুরি বাঙালি খানা এবং আমার দারুণ প্রিয়।
খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বেরুনোর প্রস্তুতি নিলাম। সাগর হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে। লিভাইস এর নেভি ব্লু জিনস, ক্যাটস্ আই এর কালো টি শার্ট পরলাম। এ দুটো ব্রান্ড আমার ফেভারিট। জেভিসি’র হ্যান্ড ক্যামেরাটা নিলাম সাথে।
তারপর আমার ট্রাভেল ব্যাগটা হাতে নিলাম, উদ্দেশ্য- টাকা নেওয়া। তখনই আমি বড়ো ধাক্কাটা খেলাম।
নেই! সত্তর হাজার টাকার একটা বান্ডিল, নেই! মাথা ঠান্ডা রাখলাম। দ্রুত ব্যাগটা উপুর করে সব জিনিস বের করে খুঁজলাম। নেই! পাওয়া গেলোনা। মাথায় হাত পড়লো।
ভেবে দেখলাম টাকা কোথায় রেখেছিলাম। পরিষ্কার মনে পড়লো ব্যাগের মধ্যেই টাকা ছিলো। তাহলে? ব্যাগ থেকে কোথায় উধাও হয়ে গেলো টাকা? রুম সার্ভিস; সে নেয়নি তো? প্রশ্নই আসেনা। কারণ সে যখন রুমে এসছিলো তখন খাওয়াটা আমার সামনে রেখেই চলে গিয়েছিলো। পরিষ্কার দেখেছি। তাহলে? গেলো কোথায় এতোগুলো টাকা?
ম্যানেজারকে ডেকে জানালাম। তিনি আন্তরিক সমবেদনা জানালেন আমাকে। বললেন-তার পক্ষে যতোদুর করা সম্ভব তিনি করবেন। রুম সার্ভিস ছেলেটাকে ডেকে ভীষণ তর্জন-গর্জন শুরু করে দিলেন। ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এ কাজ করেনি। আর আমি তো জানিই সে করেনি। সুতরাং বললাম তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ম্যানেজার বললেন থানায় একটা জিডি করার জন্য। আমি সায় দিলামনা। চিনিনা ,জানিনা একটা জায়গায় অহেতুক পুলিশি ঝামেলা মাথায় নিতে ইচ্ছে করলোনা। আর আমাদের দেশের পুলিশের উপর আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
বেড়ানো মাথায় উঠলো। হোটেলের বিল চুকিয়ে দিয়ে সোজা রাতের বাস ধরার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস হাজার পাঁচেক টাকা পকেটেই ছিলো। নইলে কি যে হতো। ম্যানেজার বেচারা ঘাবড়ে গিয়ে আমার কাছ থেকে টাকাই নিতে চাইলেননা। জোর করে গছালাম। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যেন ঘটনাটা আমি কাউকে না জানাই। তার হোটেলের সুনামের কথা যেন মাথায় রাখি। তাকে কথা দিলাম কাউকে জানাবোনা।


এরপর প্রায় দু'মাস পেরিয়ে গেছে। ম্যানেজারের অনুরোধ উপেক্ষা করে বন্ধুদেরকে ঘটনাটা বলতেই ওরা আমাকে সহানুভূতি জানানোর বদলে উল্টো খেপানো শুরু করে দিলো। বললো, উচিত হয়েছে, তাদের কথা না শোনার উপযুক্ত সাজা হয়েছে আমার।
এ দু'মাস আমি হেনার কথা একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি। পারবো কি করে, সে চেহারা কি ভোলা যায়? বারবার মনে হয়েছে আবার ওর সাথে আমার দেখা হবে। কিন্তু কি করে হবে সেটা বুঝতে পারলামনা, না আছে ঠিকানা, না আছে ফোন নাম্বার। একটা মাধ্যম তো লাগবে যোগাযোগের জন্য।
তারপর একদিন আমার কল্পনাকে সত্যি করে হেনার চিঠি এলো। প্রথমে বিশ্বাসই হলোনা, তারপর স্পষ্টাক্ষরে আমার নাম এবং ঠিকানা দেখে বাধ্য হলাম বিশ্বাস করতে। দারুণ খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম।
আমি জানতাম হেনা আমাকে ভুলতে পারবেনা। তখন মাথায়ও এলোনা, ও কি করে আমার ঠিকানা পেলো।
তারপর চিঠিটা খুলতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। সম্বোধনের জায়গাটা খালি। চিঠিটা এরকম-

'জয়'- এই চিঠি যখন আপনার হাতে পড়বে তখন আমি চাই, আপনি আমাকে এতটাই ঘৃণা করুন, যেন সেই ঘৃণায় আমি জ্বলে-পুড়ে নিঃশ্বেষ হয়ে যাই। কারণ, যে কাজ আমি করেছি তার জন্য আপনি আমাকে ঘৃণাই করতে পারেন, আর কিছু না। তবে সেই সাথে আমি এও আশা করবো, যেন আপনার মনের এক কোনে আমার জন্য একটু সহানুভুতিও রাখেন। সবকিছু খুলে বলার পর হয়তো আমি আপনার কাছ থেকে ক্ষমাও পেতে পারি।
আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান। সেই থেকে মা বটবৃক্ষের মতো আমার মাথার উপর ছায়া হয়ে আছেন। কখনো বোদ লাগতে দেননি গায়ে। কখনো বৃষ্টির ছাট আমার মাথায় পড়তে পারেনি। মা আগলে রেখেছেন আমাকে। তার সমস্ত কিছু দিয়ে আমাকে নিজের মতো করে মানুষ করেছেন।
একটা স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি করতেন। পাশাপাশি সেলাই মেশিনে অনবরত সময় কাটাতেন, যাতে দু'চার পয়সা বাড়তি ইনকাম হয়।
অভাব অনটনের সংসারে মা নিজে যুদ্ধ করেছেন, শুধুমাত্র আমাকে অবলম্বন করে। শহেরের সবচাইতে দামী স্কলে আমাকে পড়িয়েছেন।
যখন যা চেয়েছি তখন তাই মা আমাকে এনে দিয়েছেন। নিজে শতছিন্ন কাপড় পরেছেন কিন্তু আমাকে সবচেয়ে দামী কাপড়টা পরিয়েছেন। নিজে না খেয়ে থেকে আমাকে খাইয়েছেন।
আমি জানিনা কজনার ভাগ্যে এমন মা জোটে। জয়, আমার অতি প্রিয় সেই মাই যখন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন তখন আমার মতো মেয়ের কি করা প্রয়োজন? নিশ্চয়ই নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও তাকে ধরে রাখা, তাই না?
সংসারের ঘানি টানতে টানতে কখন মৃত্যু যে মাকে টানতে শুরু করে দিয়েছিলো মা নিজেও বুঝতে পারেননি। আর আমাকে তো বুঝতেই দেননি। মাঝে মাঝে মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললে পাত্তাই দিতেননা। বলতেন- সামান্য জ্বর-জারির জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই।

মার প্রাণঘাতি রোগ ক্যানসার হয়েছিলো। শয্যা নেবার একসপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরও মা যখন সোজা হয়ে উঠতে পারলেননা তখন বাধ্য হয়েই তাকে হাসপাতালে যেতে হয়। আর চেক-আপেই তার এই রোগ ধরা পড়ে।
জয়, মার এই রোগ ধরা পড়ার পর আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। কারণ-ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী মার চিকিৎসার জন্য দু’লাখ টাকার প্রয়োজন। মার আয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার চলেছে, সঞ্চয় করার মতো টাকা মার কাছে ছিলোনা। তাই এতো টাকার কথা শুনে আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম।
এই পুরুষ শাসিত সমাজে একটা মেয়ে যে কতো অসহায় আমি তখনই বুঝতে পারলাম- যখন টাকার জন্য বিভিন্ন জনের কাছে ধর্না দিলাম। নিকটজন বলতে তেমন কেউ ছিলোনা, দুরের আত্মীয়-স্বজন যারা ছিলো তারা আমাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলো। কেউ কেউ আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইলো। বলা বাহুল্য সেই সুযোগ আমি তাদের দেইনি।
তাই টাকার যোগাড়ও হলোনা। অবশেষে মার শেষ সম্বলের দিকে হাত বাড়াতে হলো, যা যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন। তার বিয়ের গয়না; সপ্ন^ ছিলো আমার বিয়েতে এগুলো উপহার দিবেন । এতো ঝড়-ঝাপটা গেছে মা ভুলেও কখনো ওগুলোর দিকে হাত বাড়াননি। কিন্তু আমাকে বাড়াতে হলো। যেখানে জীবন-মরনের প্রশ্ন সেখানে গয়না দিয়ে কি হবে।
কিন্তু তাতেও পুরো টাকার ব্যবস্থা হলোনা। কিছুতেই বাকী টাকার যোগাড় করতে পারছিলামনা আমি। শহর থেকে মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। আর আমি নিজে এখান থেকে ওখানে, এ ঘাট থেকে ওঘাট ঘুরে বেড়চ্ছিলাম। সবখানেই আমাকে বিমুখ হয়ে ফিরতে হচ্ছিলো। এদিকে মার অপারেশনের সময়ও ঘনিয়ে এসছিলো। খুব দ্রুত মার অপারেশন করা না গেলে তাকে আর বাঁচানো যাবেনা।
একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি। মার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে আমি গলায় দড়ি দিবো। মা বেঁচে না থাকলে আমার বেঁচে থেকে কি হবে।
সিদ্ধান্ত সেদিনই নিয়েছিলাম যেদিন গাড়িতে করে আপনার সাথে ফিরছিলাম। আপনার সাথে পরিচয় হলো, কথা হলো। তারপর আপনি যখন খাবার জন্য নেমে গেলেন তখনই কাজটা করলাম আমি।
বিশ্বাস করুন আপনার ব্যাগে যখন আমি হাত দিয়েছিলাম তখন নিজেকে নরকের কীটের চেয়েও অধম মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার সারা গায়ে এক বস্তা তেলাপোকা ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
জয়, যে কাজটা আমি করেছি, কখনো যে সেটা আমাকে করতে হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কারণ আমার মা আমাকে সেই শিক্ষা দেননি।
একটা মেয়ে কতো অসহায় হলে এই ধরনের একটা ঘৃণ্য কাজ করতে পারে আশা করি আপনি তা বুঝতে পারবেন। সেই বিশ্বাস আপনার উপর আমার আছে। প্রশ্ন করতে পারেন- এতো অল্প সময়ে আপনার উপর এই বিশ্বাস কেন জন্মালো আমার।
কোন কারণ নেই, শুধু আপনাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে, আপনি একজন সুন্দর মনের মানুুষ। জানিনা আপনি আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন কিনা।
যাহোক, আপনি চান বা না চান, আপনার টাকায় মার চিকিৎসা হয়েছে। মা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবে এখনো বিছানায়।
আর আপনি জেনে হয়তে খুশি হবেন যে, আমার বেশ ভালো একটা চাকরি হয়েছে। একটা বিদেশী এনজিওতে কাজ করছি আমি। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার টাকাটা শোধ করে দিতে পারবো। ও, একটা কথা বলা হয়নি- আপনার ব্যাগ থেকে টাকা নেবার সময় কি মনে করে আপনার ঠিকানাটাও নিয়েছিলাম।
মাত্র কয়েক মাস অপেক্ষা করুন, আপনার টাকাটা নিয়ে আমি নিজেই আসবো আপনার সাথে দেখা করবো আমি। ততোদিন পর্যন্ত ভালো থাকুন।

ইতি
‘‘হেনা’’

চিঠিটা পড়তে পড়তে আমি বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো ওকে যেন সামনা-সামনি দেখতে পাচ্ছি আমি। ওর প্রতি রাগ বা ঘৃনার কোন অনুভুতি কাজ করলোনা। বরং শ্রদ্ধায় নুয়ে এলো আমার মাথা। শুধুমাত্র মার প্রতি ভালোবাসার জন্য একটা মননশীল মেয়ে চুরির মতো কাজ করতে পারে, এটা আমার ধারনারও বাইরে ছিলো।
‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো হেনা, কয়েক মাস নয়, দরকার হলে কয়েক যুগ।’ চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে মনে মনে বললাম আমি।
********* 

No comments: