এরশাদ বাদশার ডায়েরি

এরশাদ বাদশার ডায়েরি
এরশাদ বাদশার বাংলা ব্লগ

Tuesday, March 31, 2015

অন্য পৃথিবী

  বেশ কিছুদিন ধরে সবকিছু কেমন যেন উল্টা-পাল্টা লাগছে আমার। জাগতিক সবকিছুর উপরেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হচ্ছে জীবনের মানেই হারিয়ে ফেলেছি আমি। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো।



  সকালে ঘুম থেকে উঠে যে কথাটি আমার প্রথমে মনে হয় তা হলো- অফিসে যেতে হবে; কিন্তু কি হবে অফিস গিয়ে? এত টাকা, এত পরিশ্রম, কার জন্য?


   জঘন্য এই ভাবনাটা নিয়ে দিন শুরু করি আমি। তারপর নাস্তা থেকে শুরু করে অফিস যাওয়া পর্যন্ত বারবার সেই ভাবনাটাই ঘুরপাক খেতে থাকে আমার মাথায়। কেন যাচ্ছি অফিস, কেন করছি এসব।

   তবে কাজে ডুবে যাবার পর সব ঠিক। কোনদিক দিয়ে যে সময় চলে যায়, আমি টেরই পাইনা। ব্যস্, ওইটুকুই; এর পরের এবং আগের প্রতিটা ক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কাটে আমার।



    একা হলে  মাথার মধ্যে বিচিত্র সব ভাবনা ঘুরতে থাকে। চা আমার খুব প্রিয় একটি পানীয়, কিন্তু ইদানীং ওটা আমার সামনে এলে  মনে হয়- এটা একটা জিনিস হলো পান করার? ঠান্ডা পানিকে গরম করে পেটের মধ্যে চালান করা। এরপরে জঘন্য চিন্তাটা মাথায় আসে- চায়ের সাথে প্রস্রাবের বেশ একটা মিল আছে; দুটোই গরম।

     একবার ভাবুনতো- কিরকম অসুস্থ চিন্তা! শুধু এই নয়, আরো আছে। রিক্রিয়েশন এর জন্য টিভি খুব ভালো একটি মাধ্যম। আগে বেশ টিভি দেখা হতো। ইদানিং টিভির সামনে বসলে অন্যরকম একটা সমস্যা হয়। ধরুন, টিভিতে কোন নাটক হচ্ছে, আমি দেখছি। কিছুক্ষণ পরেই আমার মনে হতে থাকে-এ নাটকের কাহিনী আমার জানা। শেষে কি ঘটবে তাও আমি বলে দিতে পারি। আশ্চর্যের ব্যাপার- যা ভাবি হুবহু তাই ঘটে যায়! গোল্লায় যায় টিভি দেখা।

     এভাবে সবকিছুর মধ্যেই অর্থহীনতা খুঁজে পাই আমি। কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনা। সমুদ্র সৈকতে যাবার কথা ভাবলে মনে হয়- কি হবে ওখানে গিয়ে? বিশাল বিশাল কতোগুলো ঢেউ ছাড়া কি আছে ওখানে? আর মানুষ পারেও, ওই পানির মধ্যে দাপাদাপি, লদকালদকি। চোখে-মুখে বালি ঢুকে ভরে যায়। বোরিং, সিম্পলি বোরিং। ব্যস, ঘোরাঘুরিও স্টপ।

    স্পষ্ট বুঝতে পারি আমি ডিপ্রেশনে ভুগছি। অতি উচ্চমাত্রার ডিপ্রেশন। জলদি এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। নইলে আমি হয় মারা যাবো নয়তো পাগল হয়ে যাবো।



   আমার সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু ডক্টর আসিফের কাছে গেলাম। এই শহরের নামকরা ডাক্তারদের মধ্যে সে একজন। আমি যা ধারণা করেছি সেও তাই বললো- আমি হতাশায় ভুগছি। এ কথা সে কথা জিজ্ঞেস করে সে বের করতে চাইলো, আমার এ হতাশার কারণ কি। কি বলবো আমি, নিজেও কি জানি কি কারনে আমি বিষণœতায় ভুগছি। আমার জীবনে এমন কোন দুঃখ নেই যা আমাকে এতোখানি কাবু করে ফেলবে।

       ‘চিন্তা করে দেখ’, বললো আসিফ, ‘হয়তো এমন কোন ব্যাপার আছে যা তোর অজান্তেই তোর মনের মধ্যে একটা বলয় তৈরি করেছে। যা থেকে তুই বের হয়ে আসতে পারছিসনা। আছে কি এমন কোন ব্যাপার?’

     চিন্তায় রাতে ঘুম হলোনা। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই অধ্যায়টির কথা, যার সমাপ্তি হয়ে গেছে অনেক আগেই।

     ঝড়ো এক হাওয়ার মতো এসেছিলো সে আমার জীবনে। আর আমাকে এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছিলো। যখন অনুভব করতে শিখেছিলাম বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে আমাকে জয় করে নিয়েছিলো। আমার সমস্ত ভালোলাগার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলো । যতোক্ষণ সে পাশে থাকতো ততোক্ষণ তার মধ্যে ডুবে থাকতাম, আর যখন থাকতোনা সে সময়টুকুও সে দখল করে রাখতো।



    লোকে বলে টিনএজ লাভ শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা মোটেও সেরকম ছিলোনা। প্রথম তিনটি বছর আমরা একে অপরকে বুঝলাম, জানলাম। এই তিন বছরে সে তার ভালোবাসার পরীক্ষা দিলো অনেকবার অনেকভাবে। এবং ফুলমার্কস পেয়ে পাস করে গেলো। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম, এতো মায়া আমার জন্য তার মনে কিভাবে সে ধারণ করতো। কিভাবে মন-প্রাণ একীভুত করে শুধু একজন মানুষের পূজা করতো। অবাক হতাম এবং দারুণ আপ্লুত হতাম; ওরকম একজন মেয়ের ভালোবাসা কজনের ভাগ্যে জোটে।

            

    সে তার পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিলো। আমার কাছে দেওয়া ওয়াদা সে পালন করেছিলো ভালোভাবেই। তার বাবাকে সরাসরি বলে দিয়েছিলো- বিয়ে করতে হলে ওকেই।

    তার ফ্যামিলি তার জেদের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। রাজি হয় আমার সাথে তার বিয়ে দিতে। আর পুরুষ হয়ে আমি কি করলাম? আমার ফ্যামিলিকে রাজী করাতে ব্যর্থ হলাম। এক পূর্ণিমা রাতে চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে সে আমাকে মিনতি করলো, আমি যেন তাকে নিয়ে দুরে কোথাও পালিয়ে যাই। বেঁচে থাকতে সে অন্যকারো হতে পারবেনা।

     পরিবারের বড়জন, কাঁধের উপর দায়িত্ব, আর হাতে আমার বাবার মান-সম্মান। সবমিলিয়ে আমার অবস্থা হলো মাঝ দরিয়ায় বৈঠা বিহীন নৌকার মাঝির মতো; অসহায়, অক্ষম।

      পারিনি ওর চোখের পানির মূল্য দিতে। বিয়ের দুদিন আগেও আমাকে পাগলের মতো খুঁজেছে, আমি পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিটটান দিয়েছি।

 

    শেষবারের মতো আমাকে একটা চিঠি লিখে ও, তাতে লেখা - ‘‘আমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা করেছো তুমি। মনে হয়েছিলো, তোমাকে ভালোবেসে আমার জীবন সার্থক হয়েছিলো। ভুল, দারুণ ভুল ছিল আমার ধারণা। অপাত্রে দান করেছি আমি আমার ভালোবাসা। তোমার কাছে ওয়াদা করেছিলাম, সারাজীবন তোমাকে আমার মনের মধ্যে ধরে রাখবো। আমি এখনও আমাÍ ওয়াদা পালন করবো, তবে জেনো রেখো, যতোটা ভালোবাসা দিয়েছিলাম তোমাকে, ঠিক ততোটাই ঘৃণা করবো। এবং একটা কাপুরুষকে ভালোবাসার দায়ে নিজেকে অভিশাপ দেবো।’’



    তারপর আমার একাকী পথচলা। অনেক দুরে থেকেও ওর ঘৃণার উত্তপ্ত আঁচ আমি স্পষ্ট টের পেতাম। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পড়ালেখা     বন্ধ হয়ে গেলো। পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে লাগলাম। একেতো বিদ্যার জোর কম, তার উপর মামার জোরও নেই; স্বভাবতই চাকরি হয়ে গেলো সোনার হরিণ।

  চাকরি না পাবার কারণ এগুলো হলেও আমার খালি মনে হতো, ওর ঘৃণা আমাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। শুধু আমাকে না, আমার ভাগ্যকেও।

     -এই আকালের দিনেও মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোর মতো উঁকি দিতে চাইতো ভালোবাসা। কোনো রূপবতী তার ভালোবাসার জালে বাঁধতে চাইতো, আমার দুঃখের ভাগ নিতো চাইতো। আর আমি, যে কিনা ভালোবাসা নামক বস্তুটা উজার করে দিয়েছিলো সেই মায়াবতীকে, যার ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর, আর যার ঘৃণা আগুনের লেলিহান শিখার চেয়েও ভয়ংকর।

     সেই সব নারীদের কাছ থেকে দুরে সরে যেতাম। ও চলে যাবার পর আমি অন্য কারো দিকে সেভাবে চাইতেই পারিনি। সবসময় মনে হতো সে আমার কাছাকাছিই আছে, আমাকে দেখছে।

    আমার খালি মনে হতো ওর সাথে সাথে আমার জীবনের সব সুন্দরও ফেরারী হয়ে গিয়েছিলো। জোড়াতালির জীবন আমার ধুঁকতে ধুঁকতে কোনমতে বয়ে যাচ্ছিলো। টিকে থাকার জন্য অনেক কিছুই করতে হয়েছিলো আমাকে। যা কোনদিন কল্পনাও করিনি, তাই করে টাকা উপার্জন করেছি।

   এভাবেই একসময় সাফল্যের দেখা পাই আমি। নিজের লক্ষের প্রতি অবিচল থাকার কারণেই সাফল্য আমার কাছে এসে ধরা দেয়। ছোট্ট পুঁজি দিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেছিলাম, সেটা লাভের মুখ দেখল। ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে একাকার হয়ে যাবার পর তার ডাল-পালা মেলতে শুরু করলো।

 এরপরের কাহিনী গতানুগতিক। একটু একটু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিলাম সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। মা-বাবা গ্রাম ছাড়তে রাজী হলোনা, তাই ওদের দুজন আর ছোট্ট বোনটাকে গ্রামে রেখে নিজে এই শহরের বাসিন্দা হয়ে গেলাম।

   সময়ের চেয়ে ক্ষমতাবান কোনকিছু বোধহয় পৃথিবীতে নেই। সময়ই ওকে ভুলিয়ে দিল, মুছে দিল আমার জীবন থেকে।



   আজ মনে হচ্ছে, না, সময়ও হেরে গেছে ওর কাছে। আবার আমার জীবনে ফিরে এসেছে সে। আবার তার ঘৃণার জাজ্বল্যমান মশাল হাতে নিয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাকে। এতোদিন পর আবার পুড়ছি তার অভিসম্পাতে।

   একটু একটু করে কাজ-কর্ম থেকে মন উঠে যেতে লাগলো। আমার সবগুলো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে। অন্যকারো হাতে নিজের ভাগ্যকে তুলে দিইনা আমি, এটা আমার নীতি। তবে বোধহয় এটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।

সরাসরি নিজে সবকিছু কন্ট্রোল করার কারণে যেমন আমার অনুপস্থিতিতে হাল ধরার লোকের অভাব হতে পারে এটা আমার কল্পনাতেও ছিলোনা, ঠিক তেমনি কখনো যে আমাকে কাজে না এসে বাসায় বসে থাকতে হবে এটাও ভাবিনি।

  ব্যবসার বারোটা বাজতে লাগলো, কিন্তু কোনমতেই নিজেকে সেদিকে আর ফেরাতে পারলামনা। তিল তিল করে নিজের হাতে গড়া আমার সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে পতিত হতে লাগলো।

    এতোদিন মানসিকভাবে কষ্ট পাচ্ছিলাম, এরপর শরীরও খারাপ হতে লাগলো।

                                                

                                                দুই



    রাত বারোটা বেজে দুই মিনিট; রাতের গর্ভে নতুন একটা দিনের সূচনা। বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছিলাম। মস্ত থালার মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে, কিন্তু আমার মনের আকাশে গহীন অন্ধকার। সারা অন্তর জুড়ে হাহাকার। সেই মানুষটার জন্য, যে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। জানিনা কেন এতোদিন পরে আবার তার জন্য এমন লাগছে। মনে হচ্ছে আমার মতো অপরাধী পৃথিবীতে আর একটাও হতে পারেনা। কতো কিছুই না করেছে আমাকে পাবার জন্য, আর আমি মেয়েলোকের মতো চুপ করে থেকেছি, নির্দ্ধিধায় দেখেছি ওর চলে যাওয়া। আই’ম আ কাউয়ার্ড, আ ব্লাডি কাউয়ার্ড।

       

      আজ ভ্যালেনটাইন’স ডে; ভালোবাসার দিন। একসময় আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো আজকের এই দিনটি। কিন্তু এখন এর আলাদা কোন গুরুত্ব নেই। বছরের ৩৬৪ দিন যা ভালোবাসা দিবসও তা।

     মনের অলিন্দে অনুরণন তুলতে লাগলো সেই দিন, যেদিন ভালোবাসা দিবস আমার জীবনে অন্য এক মাত্রা যোগ করেছিলো।

    প্রত্যেক ভ্যালেনটাইন’স ডেতে আমি ওর জন্য ফুল কিনতাম। সেদিনও কিনেছিলাম, আর কলেজের চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছিলাম ওর জন্য।

    ও কিছুতেই বেরুতে পারছিলোনা; আসলে বের হচ্ছিলোনা। কারণ ওর মামা কি করে যেন জেনে গিয়েছিলো আমাদের সম্পর্কের কথা। তাই সত্যতা যাচাই করার জন্য নিজেই চলে এসেছিলো। আমি জানতাম না, ওর মামা দোকানে বসে অপেক্ষা করছিলো কবে ও বেরুবে, আর আমাকে ওর সাথে দেখবে। আর এটা ও জানতো বলেই ইচ্ছে করেই বেরুচ্ছিলোনা।

      অপেক্ষার যন্ত্রণা কখনোই সহ্য হয়না আমার, তবু ওর জন্য অপেক্ষা করাটা আমার কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়না, কারণ আমি জানি ও যখন আমার সামনে আসবে তখন সব কষ্ট এক নিমিষে পরিণত হবে ভালোলাগায়।

     আকাশ কালো হয়ে গেলো কৃষ্ণ মেঘে। আমার দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্যই বোধহয় বৃষ্টিদেবী তার ঝাঁপি খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দোকানে প্রায় দেড় ঘন্টা বসে থাকার পর নির্জনে চলে এসেছিলাম যেখানে লোকজন নেই, কারণ ফুল হাতে নিয়ে দোকানে বসে থাকাটা দারুণ অস্বস্তিকর। সবাই কৌতুহলী চোখে তাকায়। ও যাবার সময় এই রাস্তা ধরেই যাবে।



   অসময়ের বৃষ্টি নাকি খুব তেজী হয়। এক মিনিটেই কম্ম সারা, ভিজে একসা করে দেবে। তবু দোকানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করলোনা।

     এলো ও, সাথে ওর বান্ধবী। ওকে দেখে চোখ কপালে উঠে গেলো আমার। সামনে যেন মানবী নয়, এক পরী দাঁড়িয়ে আছে।

     আকাশ নীল রঙের সালোয়ার কামিজ ওর পরনে। চোখে কাজল দিয়েছে পুরু করে, কানে নীল রঙের দুল। চুলে বেশ বড় করে ফুলের খোঁপা করেছে। আমি অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলাম।

   ‘সোমা, তুই এগিয়ে যা, আমি আসছি।’ বান্ধবীকে ভাগিয়ে দিল ও।

   ‘অমন হাঁ করে কি দেখছিলে, সোমা হাসছিলো’ বলল ও।

   ‘যেমন করে সেজেছো, আমি তো হাঁ করে দেখছিলাম, আর লোকজন  দেখলে সেই হাঁ এর ভিতর তোমাকে আস্ত গিলে ফেলতো।’ হেসে বললাম আমি, ‘এতো চমৎকার লাগছে তোমাকে।’ একটু থেমে আবার বললাম ‘শুভ ভালোবাসা দিবস।  নাও, এবার ফুলগুলোকে হাতে নিয়ে এগুলোকে কৃতার্থ করো; আপন ঠিকানায় যাবার জন্য সেই কখন থেকে এগুলো ম্রিয়মান হয়ে আছে।’

  ‘প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ, মাই ভ্যালেনটাইন।’ ফুলগুলো হাতে নিয়ে বলল ও। ‘হ্যাপী ভালেনটাইন’স ডে।’

  ‘সেটা ঠিক আছে, তবে প্রশংসার সাথে সাথে কিছুটা তিরস্কারও পাওনা হয়েছে তোমার, ঠিক কিনা?’

  ‘জানি তুমি রাগ করেছো, কিন্তু উপায় ছিলোনা। মামা এসছিলো, তাই বেরুচ্ছিলাম না।’

  ‘আচ্ছা, তাই নাকি?’

  ‘ভয় পেয়োনা, এতোক্ষনে নিশ্চয়ই চলে গেছে।’

  ‘না, যাইনি।’ জলদগম্ভীর একটা পুরুষ কন্ঠ বলল পিছন থেকে ‘তাড়াতাড়ি চলে গেলে তো এই সিনেমা দেখা হতোনা।’

  ‘মামা!’ ভয় পাওয়া কন্ঠে বলল ও।

  ‘এদিকে আয় নুর।’ হুকুম করল ওর মামা।

  ভীরু পায়ে এগিয়ে গেলো ও, ঠিক এ সময় ঝমঝম করে নামলো বৃষ্টি। আমরা তিনজন মানুষ সেই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে লাগলাম আলাদা আলাদা অনুভূতি নিয়ে।

  ‘আজকের পর আর কোনদিন আমার ভাগ্নির সাথে যেন তোমাকে না দেখি।’ বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে গমগম করে উঠলো মামার গলা।

  মনে মনে দারূন ভয় পেয়েছি আমি, তবে চেহারায় তার ভাব ফুটতে দিলামনা, কারণ আর যাই হোক ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে নায়কগিরি ফলানো যায়না। সরাসরি তাকিয়ে রইলাম ওর মামার দিকে।

 ‘তুমি শুনেছো আমি কি বলেছি?’

 কোন কথা বললাম না। আমার নীরবতা দেখে ক্রদ্ধ হয়ে উঠলো ওর মামা।

   বৃষ্টির শীতল জল তার আগুনের মতো মেজাজকে ঠান্ডা করতে ব্যর্থ হলো। তিনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন-‘কথা কানে যায়না, জবাব দিচ্ছোনা কেন?’

আমি তবুও চুপ করে রইলাম, দেখতে চাইলাম তিনি কতোদুর পর্যন্ত যেতে পারেন।

    তবে এর বেশি এগুলেন না তিনি, নুরকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় নুর আমার দিকে পিছন ফিরে দেখছিলো বারবার। বৃষ্টি ভেজা ওর কোমল, পবিত্র মুখটা খুব অসহায় দেখাচ্ছিলো। জানি, ও নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবছিলো।

    পরদিনই ওর চিঠি পাই আমি। তাতে লেখা-‘আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমার অপমানে আমার অপমান। আর তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার অপমানের শোধ নেবো। আমি তোমাকে বিয়ে করবো, যে করেই হোক।      তুমি নিশ্চয়ই আমার সংগে থাকবে, বলো থাকবেনা? আমরা দুজনে মিলে আমাদের স্বপ্নকে সত্যি করবো।’

    আমি ওর কাছে ওয়াদা করেছিলাম, আমরা একসাথে যুদ্ধ করবো। যে কোন মুল্যেই ওকে আমার করবো।

  

    কিন্তু অতি সহজেই ওয়াদার বরখেলাপ করি আমি। সাহসী বীরের মতো একাই লড়েছিলো ও, আর সফলও হয়েছিলো। অথচ যখন আমার পালা এলো- ভীরু কাপুরুষের মতো পিটটান দিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার মতো সৈনিকের এ অপরাধে কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত ছিলো।

    তবে এতোদিন পরে এখন আমার যে শাস্তি হচ্ছে তা কোর্ট মার্শালের চেয়ে হাজার হাজার গুন বেশি ভয়ংকর। এক পলকের জন্যও মন থেকে সরাতে পারছিনা, বারবার ওর চেহারাটা মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। আর আমার কৃতকর্মের জন্য অভিশাপ দিচ্ছে।



     আকাশের দিকে তাকালাম, দেখলাম সফেদ চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘের আঁধারে। একটু পরেই বিজলী চমকাতে লাগলো। মনে হচ্ছে বেশ জোরে বৃষ্টি হবে। ভাবতেই যা দেরি, বেশ বড়ো বড়ো ফোঁটায় শুরু হলো শিল পড়া বৃষ্টি, সেই সাথে বজ্রপাতের গুরুম গুরুম শব্দ।

     বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে একাকী বৃষ্টি দেখার মতো অসাধারণ কিছু আর আছে বলে মনে হয়না। কয়েক মহুর্তের জন্য সব কষ্ট ভুলে গেলাম, প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগলাম গভীর রাতের ঝরঝর বারিধারা।

     একটু পরেই আবার বিজলী চমকাতে লাগলো। ক্ষণে ক্ষনে আলোকিত করতে লাগলো ধরিত্রীকে। আর তখনই ঘটতে শুরু করলো অদ্ভুত এক ঘটনা।

     বাড়ির সামনের অন্ধকার লনে বিদ্যুত চমক যখন আলো ছড়ালো, ঠিক তখনই দেখলাম নুর দাঁড়িয়ে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। সবুজ শাড়ি, মাথায় টিকলি, কানে দুল। বৃষ্টির পানি ওর ফর্সা কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

     আরো দেখলাম ওর আশে-পাশে এক অপার্থিব আলো ঘিরে আছে। আর চারিদিকে অন্ধকার। আমি হতবাক হয়ে গেলাম, ভুল দেখছিনা তো।

লক্ষ্য করলাম ও হাসছে। উঠে দাঁড়ালাম, পা বাড়াতেই দেখি সব অন্ধকার, আগের মতো। বৃষ্টি পড়ছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছে, শুধু ও নেই।

     স্পষ্ট বুঝতে পারলাম হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আমার। হঠাৎ বুকে দারুণ ব্যথা অনুভব করলাম। মনে হলো যেন কেউ পাঁচশো মণ ওজনের বিশাল এক পাথর তুলে দিয়েছে আমার বুকের উপর। নড়তে-চড়তে ভীষণ ব্যথা আমাকে অবশ করে দিচ্ছে। হঠাৎ করে কেন জানি যীশুর কথা মনে পড়লো আমার। বিপথগামী ইহুদীরা যখন তাকে পেরেক দিয়ে ক্রশবিদ্ধ করেছিলো, তখন কি তার এই রকম অনুভূতি হয়েছিলো, যেমন এখন আমার হচ্ছে?

     বুকে হাত চেপে বসে পড়লাম চেয়ারের উপর। চিৎকার করে ডাকতে চাইলাম কাজের লোক হাশেমকে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুলোনা।

    মনে হলো মারা যাচ্ছি আমি, আরো মনে হলো, ঠিক এ রকম মৃত্যুই পাওনা ছিলো আমার। ধুঁকতে ধুঁকতে, ভীষণ যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়ার পর চোখ বুঁজে ঢলে পড়া।

    এরপর যা ঘটতে লাগলো, তা  বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ আছে বলে মনে হলোনা আমার। ব্যাথাটা হঠাৎ করেই অনুভব করেছিলাম, ঠিক একই ভাবে আচমকাই চলে গেলো। খুব আরামদায়ক এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো আমার সারা শরীরে। পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেলো আমার শরীর। তারপরই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটতে শুরু করলো।

    মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেলাম আমি। মনে হলো কেউ একজন আমাকে তুলে নিলো। তারপর এক পলকে আকাশে উঠে গেলাম। সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটলো ব্যাপারটা।

ভয় বা অন্য কোন অনুভূতি আমার মধ্যে কাজ করলোনা। মনে হলো ভয় পাওয়ার অনুভূতিটা ভোঁতা হয়ে গেছে।

     বুঝতে পারছি, আমি কোন যানের ভেতরে নেই, কারণ খোলা আকাশ দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। আশে-পাশে তারাদের দেখতে পাচ্ছি। তবে পিছন দিকে একটা কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করছি। একবারের জন্য মনে হলো ওটা একটা আঙ্গুল, কোন মানুষের আঙ্গুল। কোন দৈত্য কি আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যার একটি আঙ্গুলই একজন মানুষকে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ঠ?

     আশ্চর্য হলেও সত্যি, কথাটা ভাবতেই হাসি পেলো আমার। তারপর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতেই একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। খুব মৃদু হলেও, স্পষ্ট শুনতে পেলাম; এবং বুঝতে পারলাম আওয়াজটা যান্ত্রিক। তারমানে খুব শক্তিশালী কোন যান্ত্রিক বাহনে আছি আমি।

  পরীক্ষা করার জন্য শূন্যে হাত রাখলাম, উদ্দেশ্য, আশে-পাশে কোন কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় কিনা। সফল হলো উদ্দেশ্য। নিরেট কিছু একটা হাতে ঠেকলো। অনেকটা কাঁচের মতো, তবে ওটা যে কাঁচ নয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে কি এটা একটা স্পেসশীপ, মঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? হাসি পেলো আবারো; তবে হাসতে পারলামনা, কারণ স্পেসশীপ বলি আর যাই বলি, ওটার গতি অনেক বেড়ে গেলো। মনে হলো, আমাকে একটা ক্লিংকারের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রচন্ড গতিতে ঘুরতে লাগলাম। তার মধ্যেও আবছাভাবে লক্ষ্য করলাম, আমার চারিদিকে ঘিরে আছে ধুসর ধোঁয়ার একটা আস্তরণ।

   এভাবে প্রায় দু’মিনিট চক্রাকারে ঘুরার পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো যানটা। সবকিছু নীরব, নীথর হয়ে গেলো। তারপর ধোঁয়ার আস্তরণটা চোখের সামনে থেকে সরে গেলো। তারপর প্রত্যক্ষ করলাম অদ্ভুত, শ্বাসরুদ্ধকর এক সৌন্দর্য।

    মনে হলো বেহেশতের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সামনে বিশাল বনভূমি। ঘন সবুজ, সারি সারি গাছ। ঘাসের সাথে সাথে বিভিন্ন ফুল এক অন্যরকম গালিচা সৃষ্টি করেছে মাটিতে। গোলাপ, রজনীগন্ধা, অর্কিড, সূর্যমুখী, কদম ইত্যাদি চেনা গেলো। শত প্রজাতির বেশিরভাগই চিনতে পারলাম না।

    ফুরফুরে হাওয়া এসে আমার চোখে-মুখে হাত বুলাতে লাগলো। ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নিলাম, তারপর কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখলাম বিশাল এক পাহাড়। তার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টলটলে, স্বচ্ছ পানি। পানি দেখতেই পিপাসায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যেতে লাগলো। মনে হলো অনেক বছর ধরে তৃষিত আমি।

   আঁজলা ভরে পানি খেলাম, অত্যন্ত সুপেয়। আমার বুক জুড়িয়ে গেলো।

তারপর পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে চিত হয়ে শুলাম, কেন যেন খুব ক্লান্ত লাগছে। আকাশের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম আমি।

   আকাশের রঙ ঘন নীল। এতোটাই ঘন যে, আমার মনে হলো, এটা পৃথিবীর আকাশ নয়। আরো একটা ব্যাপার- এতোক্ষন যাবত আমি এখানে আছি, অথচ কোন জনমানুষের সাড়া-শব্দ নেই। অন্যরকম এক নিস্তব্দতা। অপার্থিব এক নীরবতা। কোন কোন নীরবতা মনে ভয় ধরিয়ে দেয়, কিন্তু এখানকার এই পরিবেশ মোটেও ভীতিকর মনে হচ্ছেনা। বরং খুব পবিত্র একটা অনুভূতি সারা অন্তরে জুড়ে বিরাজ করছে আমার। মনে হচ্ছে অনেক বছর ধরে অশান্ত ছিলো মন, বিক্ষিপ্ত ছিলো। কিন্তু এখানে পা রাখার পর সব অশান্তি দুর হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমার কোন দুঃখ নেই, কোন কালে ছিলোওনা।

   উঠে দাঁড়ালাম, পাহাড়ের কিনারা ধরে হাঁটতে লাগলাম। জানিনা কোথায় যাচ্ছি আমি, মনে আশা- যদি কোন লোকালয়ের সন্ধান মিলে।

হাঁটতে হাঁটতেই পাহাড়ের পিছন দিকে চলে গেলাম। সেখানে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য।

    ছোট্ট একটা নদী; না, ভুল হলো। নদী নয়, নদীর শাখা হবে হয়তো। হাঁটু পর্যন্ত পানি। দু’পাশে প্রকৃতির অকৃপন হাতের সৌন্দর্যকে রেখে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। ছোট-বড়ো নুড়ি পাথর নদীর সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো পানি। আমার প্রতিবিম্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সেখানে।

    এখন কি করবো? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম। বেশিক্ষণ ভাবতে হলোনা; দুরে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেলাম নদীর মাঝখানে বিশাল চর পড়েছে। চরের মাঝখানে ছোট্ট একটা কুটির । খুশি হয়ে উঠলাম, লোকালয়ের দেখা পেয়ে। ঘর যখন আছে, থাকার মানুষও নিশ্চয়ই আছে।

    সেই হাঁটু পানিতেই দৌড়াতে শুরু করলাম। দ্রুত পেীঁছে গেলাম কুটিরের কাছে।

    পুরোপুরি সবুজ গালিচায় মোড়া সেই চর। হাজারো ফুল ফুটে আছে কুটিরের চারিদিকে। শান্ত, নিস্তরঙ্গ; পবিত্র এক নীরবতা কুটিরের আশে-পাশে।

    ঘরটা তৈরী করা হয়েছে শন দিয়ে। তবে আমার মনে হলো- এটা সাধারণ শন নয়। পুরোপুরি নীল রঙে আচ্ছাদিত কুটির। মাঝখানে দরোজাটা সাদা। সেটা কাঠের তৈরী। দু’পাশে ছোট্ট দুটি জানালা, সেগুলোও সাদা রঙের।

   এতো সুন্দর একটা ঘর, কিন্তু কোন মানুষ-জন আছে বলে তো মনে হচ্ছেনা। আমি হাঁক দিলাম-‘কেউ আছেন?’

   কোন উত্তর আসলনা। আবার চেষ্টা করলাম- বাড়িতে কেউ আছেন?’

 ‘ভেতরে এসো রাহাত।’ আমার পিলে চমকে দিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে ভরাট, মৃদু একটা গলার আওয়াজ ভেসে এলো। আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ।

   এ অবস্থাতে যে কোন মানুষের ভয়ে আধমরা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য, আমার একটুও ভয় লাগলনা। সেই ভরাট গলার আওয়াজটা যেদিক থেকে এসছে, সেদিকে, অর্থাৎ, বাড়ির ভেতরে হেঁটে যেতে লাগলাম।

    চৌকাটে পা রাখতেই আপনা থেকেই দরোজা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকতেই সাদা আলোর বন্যায় ভেসে গেলাম। সাদা একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ঘরটা ভরে আছে ফুলে ফুলে। কোন আসবাব নেই, মাঝখানে খাটের জায়গায় ফুলশয্যা। সম্পূর্ন ফুল দিয়ে বিছানাটা তৈরী করা হয়েছে। ঘরের ভেতর বিরাজ করছে হলুদ আলো, যা সাদার সাথে মিশে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।

    আমি বিমোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এভাবে কতোক্ষন কেটে গেছে জানিনা, ঘোর ভাঙল সেই ভরাট গলার আওয়াজে। ‘কেমন আছো রাহাত?’

চমকে উঠে পিছন ফিরলাম, দেখলাম আমার সামনে শান্ত, সৌম্য এক পুরুষকে। গ্রীক দেবতাদের মতো চেহারা লোকটার, গালে চমৎকার চাপদাড়ি চেহারায় দারুণ আভিজাত্য এনে দিয়েছে। লোকটার পরনে                                     জোব্বা ধরনের একটা পোষাক, ওটার ঝুল পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত, একেবারে ধবধবে সাদা। লক্ষ্য করলাম লোকটার পায়ে কোন পাদুকা নেই, খালি পা।

‘কই, বললে না কেমন আছো?’ আবার বললেন ওনি।

‘বুঝতে পারছিনা কেমন আছি,’ জড়তা কাটিয়ে বললাম, ‘আসলে আমি জানিও না কোথায় আছি।’

হাসলেন সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক, বললেন-‘অতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন? সবই জানতে পারবে আস্তে আস্তে।’

‘আপাতত এটুকু নিশ্চয়ই জানতে পারি, আপনি কে?’

আবারো হাসলেন ওনি, চমৎকার তার হাসি। বললেন-‘চলো, আমরা বসি।’

    তিনি আমাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। এই ঘরটাও একই রকম, তবে পার্থক্য হচ্ছে এখানে বসার জন্য অনেকগুলো কুশন আছে। আর সেই কুশনগুলোও যথারীতি ফুলের।

‘বসো রাহাত,’ বললেন ভদ্রলোক, ‘তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?’

‘মনে ছিলোনা, আপনি বলাতে এখন খিদেটা চাগিয়ে উঠেছে।’

‘অপেক্ষা করো, একটু পরেই খানা চলে আসবে।’

  একটু পরেই সেই ঘরে প্রবেশ করলো অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা। তার চেহারাটার তুলনা করা যায় শুধু বৃষ্টি ঝরা শিশিরের সাথে। কোমল, স্নিগ্ধ, লাবণ্যময়। তাকে দেখে আমার একটাই কথা মনে হলো-সৌন্দর্যের নানান রকম আছে, যা এখনো দেখা বাকী আছে আমার।

  তার হাতে তিনকোনা একটা ট্রে, এবং সেটা নানা রকম ফলে ভর্তি। আঙ্গুর থেকে শুরু করে আপেল পর্যন্ত চিনতে পারলাম, কিন্তু অজানা ফলের সংখ্যাই বেশি। আর স্ফটিক সাদা এক গ্লাস দুধ।

তার পোষাকও একই রকম। সাদা জোব্বা, তবে মাথায় একটা স্কার্ফ। কোন অলংকার নেই এবং পা যথারীতি খালি।

   ‘রাহাত, খাওয়া শুরু করো, তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।’ কন্ঠে সুরের ঝংকার তুলে বললেন মহিলা; অপূর্ব সুন্দর তার গলার আওয়াজ।

আবারো অবাক হবার পালা আমার, এই মহিলাও আমাকে চেনেন।

খেলাম আমি, খুব তৃপ্তি সহকারে। খুব সুস্বাদু সেই ফলগুলোর পর অত্যন্ত মিষ্টি দুধটা অমৃতের মতো লাগল আমার।



  ভরপেট খাওয়ার পর আমার চোখ বুঁজে আসতে লাগলো ঘুমে। ভদ্রলোক

  মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন-‘শিরি, যাও অতিথিকে শোবার ঘর দেখিয়ে দাও।’

  মহিলার নাম তাহলে শিরি, ভাবলাম। তার পেছন পেছন অন্য একটা রুমে ঢুকলাম, এবং অবাক হয়ে গেলাম। এই ঘরটার ছাদ নেই, পুরোপুরি খালি।

   শোবার খাটটা যথারীতি ফুলের। উপরে ঘন নীল আকাশ, তারাভরা। অসংখ্য তারাদের ভীড়ে আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। এবং আবারো অবাক হবার পালা আমার। চাঁদের রঙ সাদা নয়, নীলাভ। অদ্ভুত সুন্দর এক আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে সেই নীল চাঁদ থেকে আর সেই নীলাভ আলোয় ভরে গেছে সারা ঘর।’



   সেই গানটার কথা মনে পড়লো আমার-‘নীল চাঁদোয়া, আকাশটাকে আজ লাগছে যেন.....’

   মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম-‘অনেকগুলো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে আমার মনে, আমি কি আপনার কাছ থেকে জবাব পাবো?’

হাসলেন ভদ্রমহিলা, বললেন-‘জানি, কৌতুহল হচ্ছে তোমার, তবে সব প্রশ্নের জবাব কাল পাবে তুমি। এখন ঘুমাও।’

‘যাকগে, এটুকু বলবেন কি, এই ঘরের ছাদ নেই কেন?’

‘তার উত্তর তুমি তখনই পেয়ে যাবে, যখন তুমি খাটে শোবে ঘুমানোর জন্য। এখন আর কোন কথা নয়, শুয়ে পড়ো; শুভরাত্রি।’

‘শুভরাত্রি।’



   বিছনায় শোয়ার পর অত্যন্ত আরামদায়ক একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো সারা শরীরে। কোমল, তুলতুলে নরম বিছানা। তবে কেন জানি ঘুম আসছেনা। ভাবছি, কোথায় আছি আমি। মারা যাইনি তো?

   এটা পৃথিবী নয়, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পৃথিবীর মতো, তবে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সুন্দর। শুরু থেকে যা যা ঘটেছিলো সব চোখের সামনে ভাসতে লাগলো আমার। চোখ থেকে ঘুম পালালো, এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলাম, যা এখানে আসার পর একবারের জন্যও হয়নি।

   আকাশের দিকে তাকালাম খোলা ছাদ দিয়ে। নীল চাঁদের উপর চোখ পড়তেই আমার সব অস্থিরতা এক নিমিষে দুর হয়ে গেলো। তখনই বুঝতে পারলাম কেন শোবার ঘরের এই ছাদটা খোলা রাখা হয়েছে। চাঁদের আলোয় দেখলাম সাদা পোষাক পরা কতোগুলো মেয়ে তারাদের ভীড়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব সুন্দর তাদের চেহারা, পরী বললেও অত্যুক্তি হবেনা মোটেও। তাদের কন্ঠে মধুর গান, যদিও ভাষাটা আমি বুঝতে পারলাম না, তবে মনে হলো এটা ঘুমপাড়ানি গান। কারণ এর

পরেই আমার দু’ চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। চোখ বুঁজতে বুঁজতে আবার মনে হলো- আমার কোন দুঃখ নেই, কোন কালে ছিলোনা; পরিপূর্ণ সুখী বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক তাই।



                                        তিন



       সকালে ঘুম ভাঙলো মিঠে রোদ চোখের উপর পড়তেই। চোখ খুলেই আবারো অবাক হবার পালা আমার। সূর্য্যের রঙ লাল নয়, হালকা হলুদ রঙের। হলুদাভ সেই আলো মোটেও কড়া নয়, মিঠে। গতকাল কেন এটা আমার চোখে পড়েনি, প্রথমে সেই কথাটাই মনে পড়লো। এবং জবাবও পেয়ে গেলাম; গতকাল শেষ বিকেলের দিকে যানটা আমাকে নিয়ে আসে। তখন পড়ন্ত বেলায় অস্ত যাওয়া সূর্য্যরে আলো আর এখনকার আলোর মধ্যে পার্থক্যটা চোখে পড়েনি।

     কিন্তু সেই সাথে আরো একটা খটকা মনের মধ্যে ঝুলে রইলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, যখন অদ্ভুত যানটা আমাকে শুন্যে তুলে নিয়ে এখানে চলে আসে, তখন সময়টা ছিলো মধ্যরাত ,বৃষ্টি হচ্ছিলো।

   তাহলে কি দাঁড়ালো? পৃথিবীতে যখন রাত এখানে তখন দিন। সেই প্রশ্নটা আবারো উঁকি দিলো আমার মনে-কোথায় আছি আমি?

   সৌম্য চেহারার সুদর্শন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন-‘কি রাহাত, ঘুম হয়েছে তো?’

   ‘একেবারে সাউন্ড স্লীপ।’ বললাম।

‘ঠিক আছে, তাহলে এসো, নাস্তা করে রেডি হও। তোমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।’

‘কোথায়?

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

   নাস্তার আয়োজনও বিশাল। আমাদের পৃথিবীতে প্রচলিত কতোগুলো আইটেম ছাড়া অন্যগুলোর সাথে আমি পরিচিত নই। একটা আইটেমের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ভদ্রলোক আমাকে জানালেন-‘এটা ‘‘উয়েল’’ নামক একটা পাখির কলিজা দিয়ে তৈরী এক ধরনের কিমা, যা এখানে বেশ জনপ্রিয়।’

   খেয়ে দেখলাম, বেশ সুস্বাদু। সবশেষে একটা পানীয় পরিবেশন করা হলো যেটা নাকি বিভিন্ন ফলের নির্যাস থেকে তৈরী। অনেকগুলো ফলের নাম বললেন তিনি, যার একটাও আমি চিনতে পারলামনা। ওটা খাওয়ার পর বেশ চাঙ্গা বোধ করলাম।

  ভদ্রলোক জানালেন- সকালে এই পানীয়টা সারাদিনের জন্য চাঙ্গা রাখে। এখানে সবাই এটার ভক্ত।

  ‘আচ্ছা, একটা ব্যাপার’ বললাম, ‘এতো আয়োজন, এতো কিছু , সব কি আপনার স্ত্রীই করেন?’

  হাসলেন তিনি, বললেন-‘না, আসলে এখানকার খাবার-দাবার সব প্রাসাদ থেকেই আসে।’

  ‘প্রাসাদ?’

  ‘হ্যাঁ, রাজপ্রাসাদ।’

  ‘মানে....’

  ‘আর কোন প্রশ্ন নয়,’ আমাকে থামিয়ে দিলেন উনি,‘তোমার খাওয়া শেষ হয়ে থাকলে উঠে পড়ো, আমাদের এবার যেতে হবে।’

  জিজ্ঞেস করলামনা, কোথায়, কারণ জানি, জবাব পাবোনা।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানালেন শিরি। দ্বীপের কিনারায় দাঁড়ানো একটা নৌকা। সচরাচর নৌকার রঙ থাকে কালো; তবে এটার রঙ নীল। মাঝখানে বসার জন্য ব্যাবস্থা করা হয়েছে। আর তার আচ্ছাদন ফুলের। তবে যেটা আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক করলো, তা হচ্ছে- নৌকাটা চালাবে কে? কারণ ওটায় কোন লোক নেই।

‘চলো, রাহাত, নৌকায় উঠো।’ বললেন ভদ্রলোক।

   আমরা নৌকায় উঠলাম। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আপনা থেকেই চলতে শুরু করলো ওটা, কোন ইনজিনের কাজ নয়, এটা দেখতেই পাচ্ছি। ‘এটা চলছে কি করে?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম আমি।

‘চিন্তা করোনা, ওটা প্রাসাদের দিকেই যাচ্ছে।’ হেসে বললেন উনি। নৌকা চলতে চলতে শাখা পেরিয়ে গভীরে প্রবেশ করলো।

   নদীর দু’পাড়ের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। এতোটাই সবুজ যে চোখ ধরে যায়। গাছ-পালা আর ফুলে ফুলে ভরা। কিছুু দুরে সবুজ পাহাড়ের সারি, আর তার কোল ঘেঁষে নীল পানির ঝর্ণাধারা। সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর। কোন জনমানুষের টিকিটি পর্যন্ত নেই।

   দেখতে দেখতে আমার মনে হতে লাগলো-এখানে কোন দুঃখ নেই, নেই কোন কষ্ট। শুধু সুখ, শুধুই শান্তি। এখানে অর্থের জন্য কেউ কাউকে আঘাত করেনা, এখানে মানুষে-মানুষে বিবাদ নেই। এখানে জীবনের তাগিদে ছুটে বেড়াতে হয়না এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

    নৌকায় আমাদের মধ্যে কোন কথা হলোনা। ভদ্রলোক কোন কথা বললেন না, আমিও তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

   আমাদের নৌকা একটা সরু প্যাসেজে প্রবেশ করলো। এখানে এসে নদী ছোট হয়ে গেছে। মনে হলো এটা আরেকটা শাখা। সেই সাথে বদলে যেতে লাগলো চারপাশের দৃশ্যপট। গাছ-পালার সংখ্যা কমে গেলো, ফুলের সুদৃশ্য বাগান চোখে পড়লো। আর তার মাঝখানে পাথুরে দেয়াল। খুব বেশি উঁচু নয়। কয়েক ফুট দুরে দুরে এক-একটা দেয়াল। ওগুলোর গায়ে খোদাই করা পাথুরে ভাস্কর্য। নর-নারীর মুর্তি। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো আমার। এগুলো দুর্লভ এক-একটা ভাস্কর্য। আমাদের ওখানে পেলে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে।

   আমি বিমোহিত হয়ে দেখতে লাগলাম। কিছুদুর এগুতেই চোখ পড়লো বিশাল এক তোরণ। দেখে মনে হলো খুব দামী পাথরের তৈরী। নদীর দু’পাশে এটার ভিত্তি। তোরণটার গায়ে সোনালী হরফে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে। পড়তে পারলাম না, কারণ ভাষাটা দুর্বোধ্য। তারপর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো। ওটার লেখাগুলো বদলে গিয়ে বাংলায় রুপান্তরিত হতে লাগলো। স্পষ্ট পড়তে পারলাম-‘‘মানুষের জীবন বহতা নদীতে ভাসানো একটি নৌকার মতো, নদীর এক একটা ঢেউ জীবনের এক একটা উত্থান-পতনের চিহ্ন। আর উত্তাল সেই নদীতে যে টিকে থাকতে পারে সেই ভালো মাঝি।’’

  এটা একটা বাণী, কিন্তু এখানে এর মানে কি? এই জন-মানবহীন পৃথিবীতে(?) এটা কার জন্য। প্রশ্নগুলো মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগলো। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য।

  ঠিক একই রকম আরো একটা তোরণ এবং তার গায়ে আরো একটি বাণী- ‘স্বপ্ন আর ভালোবাসা একে অপরের পরিপূরক, যে স্বপ্ন দেখতে জানেনা সে ভালোবাসতে জানেনা, অথবা যে ভালোবাসেনা সে স্বপ্ন দেখতে জানেনা।’

  আমার বিস্ময়ের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো শেষ তোরণটার গায়ের লেখা দেখে-‘‘ভালোবাসা ভালোবাসাই; ভালোবাসলে ভালোবাসাকে পেতেই হবে, এরকম কোন কথা নেই। এমন অনেক ভালোবাসা হয়, যা প্রতিদান চায়না।’’

  প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উত্তরে তিনি শুধু মুচকি হাসলেন।

  এরপরের পথটকুর দৃশ্য আর একরকম। প্যাসেজের দু’পাড় এখন আর মাটির নয়, পাথরের। তাও আবার সাধারণ পাথর নয়, মার্বেল পাথরের। আর দু’পাড়ে কয়েক ফুট দুরে দুরে বিশাল মোমবাতির আলোক সজ্জা।

  কেন যেন মনে হলো আমরা প্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এবং আমার ধারণা যে মিথ্যে নয় তা একটু পরেই প্রমাণ হয়ে গেলো।

  বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম। প্রাসাদ শুনে মনে হয়েছিলো আমার ভাবনার চাইতেও বড় হবে সেটা। আদতে মোটেও তা নয়। খুব সাধারণ একটা পাথরের ঘর। নদীর শাখা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানেই এর ভিত্তি। বাদামী রঙের ভবনটির চারিদিকে খুব যতেœর সাথে ফুলের বাগান তৈরী করা হয়েছে। আর মোমবাতির মশাল তো আছেই।

  সচরাচর প্রাসাদকে ঘিরে যে হাঁক-ডাক থাকে এখানে তার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এমনকি দ্বার-রক্ষী বা সৈন্য-সামন্ত, কিছুই নেই। এটা কি প্রাসাদ না মৃত্যুপুরী?

  তবে পানির মধ্যে প্রাসাদটাকে চমৎকার লাগছে, এ কথা স্বীকার করতেই হয়।

   আমার সাথের ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে চত্বরে নামলেন। পিছন ফিরে দেখলাম নৌকাটা বাঁধা-ছাঁদা ছাড়াই দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।

   আমরা প্রাসাদে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম বিশাল করিডোর। তার দু’পাশে বিশাল বিশাল কাঠের দরোজা। ভেতরে অদৃশ্য উৎস থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে মায়াবী নীল আলো। প্রাসাদের ভেতরের রঙ পিংক। তার সাথে নীলের অদ্ভুত সুন্দর কম্বিনেশন।

  আমার সঙ্গী করিডোর ধরে সোজা হেঁটে যাচ্ছেন; তাকে অনুসরণ করছি আমি। শেষ মাথায় গিয়ে থামলেন তিনি; একটা বিশাল দরোজা সেখানে। দক্ষ কারিগরের নিপুন হাতে খোদাই করা নারী-পুরুষের যুগল মুর্তি শোভা পাচ্ছে সেটার গায়ে। 

   কোন রক্ষীর দ্বারা নয়, আপনা থেকেই খুলে গেলো দরোজা। ঘরে প্রবেশ করলাম আমরা।

  প্রথমবারের মতো দেখলাম মানুষের একটি দল। দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কতোগুলো নারী-পুরুষ। আর মাঝখানে উঁচু একটি আসনে বসে আছেন অভিজাত, সেীম্য, সুদর্শন একজন মানুষ। প্রথম দেখাতেই আমার মনে হলো- এ রাজা না হয়েই যায়না।

   ‘এসো রাহাত,’ কথা বলে উঠলেন তিনি, বদ্ধ ঘরে গমগম করে উঠল তার ভরাট গলা, ‘স্বাগতম।’

 সাথে সাথে দাঁড়িয়ে থাকা সমবেত নারী-পুরুষেরা একই সাথে বলে উঠল- ‘স্বাগতম, ভালোবাসার পৃথিবীতে স্বাগতম।’

 ‘ফরহাদ, কই আমাদের নতুন অতিথিকে নিয়ে এসো।’ আবারো বলে উঠলেন সেই সুদর্শন পুরুষ।

  তাহলে ভদ্রলোকের নাম ফরহাদ। আমাকে বসানো হলো সেই ব্যক্তিটির পাশের একটি কুশনে যেটি যথারীতি ফুলের তৈরী। আর আমার সঙ্গী, যার নাম ফরহাদ, তিনি বসলেন সেই সব মানুষদের সাথে, যারা এতোক্ষন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন।

   আমি লক্ষ্য করলাম, এখানে যারা আছেন তাদের সবার পোষাক একই রকম, সবার পা খালি। এমনকি যিনি রাজা( এখনো পর্যন্ত এটা আমার ধারণা।) তারও। বাড়তি কোন কিছুই নেই।

   ‘রাহাত,’ বললেন রাজা, ‘তুমি নিশ্চয়ই ছটফট করছো, সব কিছু শোনার জন্য?’

   ‘অবশ্যই, আমি এখনও জানিনা কোথায় আছি।’

 হাসলেন ওনি, বললেন-‘বুঝতে পারছি, তুমি বেশ অস্থির বোধ করছো। সব কিছু শোনার আগে সবার সাথে পরিচিত হয়ে নাও।’

 এরপর ওনি নিজে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর তারপরেই আমি সবচাইতে বড় ধাক্কাটা খেলাম।

  ডানদিকের সারিতে প্রথম যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি বেশ দীর্ঘকায়। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা ঋজু। গালে ছোট করে ছাঁটা চাপদাড়িতে চমৎকার মানিয়ে গেছে। অনেকটা আরবদের মতো লাগছে তাকে।

  ‘ইনি হচ্ছেন মজনু। আর তার পাশে যাকে দেখছো তার নাম লাইলি।’

স্রেফ হাঁ হয়ে গেলাম আমি। কি শুনছি এসব! লাইলি, মজনু! নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার, কি শুনতে কি শুনছি।

   যাকে লাইলি বলা হচ্ছে, তার চেহারাটা দারুণ আকর্ষণীয়। সবচাইতে সুন্দর তার চোখ দুটো; টানা টানা, মাদকতাময়।

   ‘ইনি হচ্ছেন চন্ডীদাস।’ বিস্ময়ের রেশ না কাটতেই আবারো ধাক্কা। মনে মনে বলতে লাগলাম- এ সব সত্যি নয়, সব মিথ্যে, সব।    

   ‘আর তার সাথে দাঁড়ানো এই মহিলার নাম রজকিনী।’ আমি চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম, লক্ষ্য করে ওনি বলে উঠলেন-‘জানি রাহাত, তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। সব কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করো, তখন পরিষ্কার হয়ে যাবে পুরো ব্যাপারটা।’

  সদ্য পরিচতদের ভালো করে দেখলাম। চন্ডীদাসের বাবরি দোলানো লম্বা চুল। চেহারাটা যেন পুরোনো দিনের জমিদারদের মতো। আর রজকীনির চেহারায় শিশির ঝরা ভোরের স্নিগ্ধতা। অবয়বে খেলা করছে বাঙালি সৌন্দর্য।

  ‘আর’ এবার বাম পাশে দাঁড়ানোদের থেকে শুরু করলেন তিনি, ‘ইনি হচ্ছেন মমতাজ। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শাহাজাহান।’

  আমি তখন বিস্মিত হবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। কোন কথা বললাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম- দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়।

   মমতাজের চেহারা যেরকম হওয়ার কথা ঠিক সেরকমই। আরব্য রজনীর শাহারাজাদের উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা নায়িকাদের মতো। আর  শাহাজাহান একটু স্থুলকায়। তবে চেহারায় ঠিকরে বেরুচ্ছে আভিজাত্য। তার বাঁকানো গোঁফ আমাকে মনে করিয়ে দিল যে, তিনি পরাক্রমশালী একজন সম্রাট ছিলেন এককালে।         

  তারপর একে একে আরো চারটি জোড়ার সাথে পরিচয় হলো। এরা হচ্ছে-‘মাসুদ-অনীতা, প্রীতম-রাধিকা, জেরোম-ফ্রিডা, আর সুশান্ত-নবনীতা।’

  ‘রাহাত,’ আবার শুরু করলেন রাজা, ‘সবার সাথে তো পরিচয় হলো, আর যার ঘরে তুমি অতিথি হয়ে ছিলে, সে কে জানো?’

  আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, একটু পর বললাম-‘আগে জানতাম না, তবে এখন ধারণা করতে পারছি। ওনারা শিরি-ফরহাদ।’

  ‘ঠিক ধরেছো’ হেসে বললেন রাজা।

  ‘তবে এখনও আমি জানিনা এসবের মানে কি। আমি তো জানতাম এরা সবাই অনেক আগে মারা গেছেন।’

  ‘হ্যাঁ, রাহাত, পৃথিবী থেকে ইনারা গত হয়ে গেছেন অনেক আগেই। আর তাদের পবিত্র আত্মারা এখানে বাস করছেন।’

  কি সব গাঁজাখুরি, ভাবলাম আমি।

  ‘এটা পৃথিবী নয়, রাহাত, গাঁজাখুরি সব ওখানেই। এখানে মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, অন্যায়-অত্যাচার কিছু নেই।’ আমার পিলে চমকে দিয়ে বললেন রাজা। ওনি কি মনের কথাও পড়তে পারেন!

   ‘মন দিয়ে শুনো কি বলছি।’ একটু দম নিয়ে শুরু করলেন রাজা, ‘পৃথিবীর আদি থেকেই মানুষ ভালোবাসছে। বাবা-মা আর সন্তানের ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসায় বলতে গেলে ভরা পৃথিবী। আর নর-নারীর যে ভালোবাসা তার জন্যই দুনিয়া সৃষ্টি করেছিলেন বিধাতা।

  এ এমন এক সম্পর্ক যা সবার উপরে। তবে সেটা তখনই যখন সে সম্পর্কের মধ্যে নিরেট পবিত্রতা থাকবে। থাকবে নির্জলা প্রেম। তবে এখন                          সেরকম প্রেম কোটিতে একটা মেলে। আজকাল সম্পর্কের মধ্যে নোংরামী, বেলেল্লেপনা ঢুকে পড়েছে। হারিয়ে যেতে বসেছে খাঁটি ভালোবাসা।

  তবে এখনও মানুষ ভালোবাসে, মন থেকে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে, সবকিছু উজার করে ভালোবাসে। আর হয়ে যায় ইতহাসের অংশ। মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাদের নাম। মরে গিয়েও থেকে যায় অমর।

   সেই সব মহান মানুষদের জন্যই এই নতুন পৃথিবী। এখানে তাদেরই বসবাস যারা সত্যিকার ভালোবাসার সংজ্ঞা শিখিয়েছে মানুষকে। বিধাতা তাদের জন্য এই নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।

    রাহাত, এখানে আছে শুধু ভালোবাসা। খুব সহজ এখানের জীবন। তুমি দেখেছো- এখানে চারিদিকে ফুলের ছড়াছড়ি। কারণটা খুব সোজা- ফুল হচ্ছে ভালোবাসার প্রতীক, সুন্দরের নিশান। তোমাদের পৃথিবীর চেয়ে এই পৃথিবী হাজারগুন বেশি সুন্দর। এই সুন্দর মানুষগুলোর জন্য একটা সুন্দর পৃথিবীর খুব দরকার ছিলো রাহাত। তাই বিধাতা এই অন্য পৃথিবীর সৃষ্টি করেছেন।’

    আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, এই পৃথিবীতে আমি কেন?

  ‘তুমিও তাদেরই একজন রাহাত। তোমার সত্যিকার ভালোবাসা তোমাকে এই পৃথিবীর একজন হবার যোগ্যতা দিয়েছে।’ আবারো আমার ভাবনার প্রশ্নের উত্তর দিলেন রাজা।

  ‘আর আমাদের এই নতুন পৃথিবীর নাম কি জানো রাহাত?’ এবারের প্রশ্নটা রাজা নয়, এলো ফরহাদ এর তরফ থেকে।

  ‘কি?’

  ‘ভ্যালেনটাইন। আর আমাদের রাজা হচ্ছেন তিনিই।’

  ‘কোথায় ওনি?’

  ‘এই তো তোমার সামনেই।’ বললেন ফরহাদ।

  দেখলাম তাকে। এতোক্ষন তিনি সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, মনে মনে ধারণাও জন্মেছিলো যে রাজা তিনিই। তবে তিনি যে ভ্যালেনটাইন হতে পারেন সেটা ধারণার বাইরে ছিলো।           

  কিছুক্ষণ চুপচাপ সবকিছু। তারপর সেই নীরবতার অবসান ঘটালেন ভ্যালেনটাইন, বললেন-‘আরো অনেক মানুষের বসবাস আমাদের এখানে, যাদের তুমি দেখবে কাল উৎসবের রাতে।’

 ‘উৎসবের রাত?’

 ‘আমাদের এখানে বলতে গেলে প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাতই উৎসবের। তবে নতুন কোন অথিতি বা বাসিন্দা এলে তাদেরকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করা হয়।’ তথ্যটা জানালেন মজনু।

 ‘তাছাড়া তোমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজও আছে, যেটা তুমি কাল রাতেই পাবে।’ বললেন চন্ডীদাস।

  আমি বুঝতে পারলাম না সারপ্রাইজটা কি হতে পারে। তবে সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না।

‘তুমি কি এখনই রাতের খাবার খাবে রাহাত?’ বললেন ভ্যালেনটাইন।

‘খাবো, তবে তার আগে আমি রাণীকে দেখবো।’ বললাম, এখানে যারা আছে তাদের প্রায় সবার প্রেম-কাহিনী আমার জানা। ভ্যালেনটাইন সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা নেই। কি কারনে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিলো, তিনি কে ছিলেন, আর কি করেই বা ভ্যালেনটাইন’স ডে চালু হয়েছিলো আমাদের পৃথিবীতে,  সে সব জানার জন্য খুব আগ্রহ আমার। তাই রাণীকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম।

  আমার কথা শুনে হাসলেন ভ্যালেনটাইন, বললেন-‘রাণী নিজ হাতে তোমার জন্য রান্না করছেন। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আজ আমরা তিনজন একসাথে খাবো।’

  আমি চমৎকৃত হলাম। রাণী নিজ হাতে আমার জন্য রান্না করছেন!

  ‘এখানে রাজা-রাণী আর প্রজাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তুমি সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, রাণীর হাতের রান্না এখানের সবাই একবার হলেও খেয়েছে।’ বললেন রাজা।



  সবাই চলে গেলো। ফরহাদকে থাকতে বলেছিলেন সেইন্ট ভ্যালেনটাইন, কিন্তু শিরি একা থাকবে, তাই তিনি চলে গেলেন।

  রাতে রাণীর সাথে দেখা হলো আমার। খুব নিষ্পাপ, সরল একটা মুখ। তাকে দেখে বইতে পড়া রোমান সাম্রাজ্যের কথা মনে পড়ে গেলো আমার।  কোঁকড়ানো চুলগুলো অন্যরকম একটা স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে তার চেহারায়।    

  তিনি আমাকে হাত ধরে ফুলের কুশনে বসালেন। বললেন-‘রাহাত, কেমন আছো?’

  আমি মুগ্ধ হয়ে তখনো তাকে দেখছিলাম, তার কথায় ঘোর ভাঙল, থতমত খেয়ে বললাম-‘জি, ভালো।’

  ‘আমি ড্রয়িং । তোমাকে ভ্যালেনটাইন এ স্বাগতম।’

  ‘ধন্যবাদ।’ খেয়াল করলাম, নিজেকে তিনি রাণী বলে পরিচয় দিলেন না।

  ‘কেমন লাগছে আমাদের এখানে?’

  ‘চমৎকার। এ গ্রহ যেমন সুন্দর তেমনি এখানকার মানুষগুলো।’

  ‘ঠিকই বলেছো, সুন্দর মানুষের জন্য সুন্দর পৃথিবী।’

  ‘কিন্তু, একটা ব্যাপার আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা।

  ‘সেটা কি রকম?’

  ‘পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যেখানে মঙ্গলে বসবাসের চিন্তা করছে, সেখানে পৃথিবীরই মতো এতো সুন্দর একটা গ্রহের হদিস জানলোনা, এটা কেমন কথা?’

  আমার কথা শুনে হাসলেন রাণী, বললেন-‘রাহাত, বিজ্ঞানীদেরও খোদাতালাই সৃষ্টি করেছেন। তারা এতো কিছু করছে, যেই মস্তিস্কের সাহায্যে সেটাও তার দেওয়া। বিজ্ঞানীরা আর যাই করুক, নিশ্চয়ই তার আগে যেতে পারেনা, নাকি?’

বুঝতে পারলাম তিনি কি বলতে চাইছেন, তাই আর সেদিকে গেলাম না।



  খাওয়ার টেবিলে তিনজন একসাথে বসলাম। আমি, ভ্যালেনটাইন এবং রানী ড্রয়িং। খেতে খেতে অনেক কথা হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম- এ গ্রহের মুল ভাষাটা কি?

    উত্তর দিলেন রাজা, বললেন-‘এখানে নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই। নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলে অধিবাসিরা। আর নতুন কোন বাসিন্দা এলে তাকে তার ভাষায়ই স্বাগতম জানানো হয়। এখানে ভাষার জন্য কোন অসুবিধা হয় না।’

  আমি রাণীকে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে সেইন্ট ভ্যালেনটাইনের সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি জানেন কিনা পৃথিবীর বাসিন্দারা যে ভ্যালেনটাইনস ডে পালন করে।

  উত্তরে তিনি জানালেন- তিনি জানেন ভ্যালেনটাইন’স ডের কথা। তবে সবকিছুর জানার জন্য তিনি আমাকে কাল উৎসবের রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন।

                              

                                       চার



  উৎসবের রাত এসে গেলো। আমাকে উৎসবের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হলো।

  রাণী নিজ হাতে আমাকে এখানের পোষাক সেই সাদা জোব্বাটা পরিয়ে দিলেন। আমার পা থেকে জুতো জোড়া খুলে নেওয়া হলো।

  তারপর রানী সস্নেহে আমার কপালে চুমু খেলেন। বললেন-‘খোদা তোমার মঙ্গল করুন।’



   নীলাভ চাঁদের আলোয় বিশাল নৌকায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। রাজা, রানী এবং আমাকে নিয়ে নৌকা আপনা থেকেই চলতে শুরু করলো।

 নীল জলরাশির মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলো আমাদের বাহন। নীল আলোয় চারপাশের প্রকৃতিকে অপার্থিব মনে হতে লাগলো। অপার্থিব, কিন্তু ভীতিকর নয়।

  ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ রাজাকে জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘উৎসবের জন্য এখানের মানুষ একটা পাহাড়ে সমবেত হয়। পাহাড়টার নাম হচ্ছে-মৃদঙ্গ। আমরা সেখানেই যাচ্ছি।’

   নৌকা পেীঁছে গেলো বিশাল একটা পাহাড়ের কাছে। দেখে মনে হলো এটাই সেই মৃদঙ্গ। অবাক হয়ে গেলাম আমি। নদীর মাঝখানে বিশাল চর দেখেছি, কিন্তু এতো উঁচু পাহাড় কখনো স্বপ্নেও দেখেনি। ঘন সবুজে মোড়া পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে উপরের দিকে। এতোটাই উঁচু যে দৃষ্টি চলেনা ।

 নৌকা থেমে গেলো। রাজা বললেন-‘রাহাত, নেমে পড়ো, আমাদের গন্তব্য এসে গেছে।’

  পাহাড়ের গায়ে উঠার জন্য সুন্দর করে খাঁজ কাটা হয়েছে। কিন্তু আমি ভয় পেলাম, এতো উঁচু পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে?

  ‘চিন্তা করোনা রাহাত, উঠতে শুরু করো, দেখবে খুব সহজেই উঠে যাচ্ছো তুমি।’ আমার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন বললেন রাজা।

  আসলেই তাই, পাহাড়ের গায়ে পা রাখতেই আপনা থেকেই যেন চলতে শুরু করলাম। পা ফেলতেই যা দেরি, তরতর করে উঠে যেতে লাগলাম। অনেকটা চাঁদের দেশে নভোচারিরা যেরকম করে হাঁটে সেরকম।

  রাজা-রানী আমার আগে আগে আমি পিছে। এভাবে কতোক্ষণ কেটে গেছে জানিনা, হঠাৎ দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি সমতলে। ধবধবে সাদা ধোঁয়ার বলয় আমার চারপাশে, আর কোনকিছুই দৃশ্যমান নয়। ভয় পেলাম, কোথায় এসেছি আমি? রাজা-রাণীকেও তো দেখছি না।

   তারপর আস্তে আস্তে ধোঁয়ার বলয় সরে যেতে লাগলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক অভূতপূর্ব, শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য।

  আমি দাঁড়িয়ে আছি বিশাল এক দুর্গের সামনে। বাদামী রঙের সেই দুর্গটা আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, সমতলের কিনারা ছুঁয়ে। আর ক্ষণে    ক্ষণে সাদা মেঘের সারি ছুঁয়ে যাচ্ছে ওটাকে। আর তখনই বুঝতে পারলাম, আমার চারপাশে সাদা ধোঁয়ার বলয়টা আসলে ধোঁয়া নয়, মেঘই ছিলো। রাতের নীল আলোয় বাদামী দুর্গটাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। ভয়ংকর সুন্দর এ কারনে যে, এখানে কোন মানুষের সাড়া-শব্দ নেই।



  পিছন থেকে ভ্যালেনটাইনের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম-‘রাহাত, কি ভাবছো?’

‘ভাবছি, এটা কি পরিত্যক্ত কোন রাজপ্রাসাদ?’

‘মোটেও না, এটাই সেই উৎসব ঘর। দেখো......’ তিনি হাত দিয়ে পাহাড়ের নিচে নদীর দিকে ইঙ্গিত করলেন।

নিচে দৃষ্টি ফেলতেই আমার চোখ সেখানেই আটকে গেলো। নীল চন্দ্রালোকে নদীর নীল জলরাশিতে যেন সাদা বরফের মেলা বসেছে। টুকরো টুকরো সাদা বরফ যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে।



‘সবাই উৎসবে যোগ দেবার জন্য আসছে।’ বললেন রানী।



  রানীর কথায় খেয়াল করে দেখলাম, যেগুলোকে আমি বরফের টুকরো ভাবছিলাম, আসলে সেগুলো মোটেও তা নয়। সাদা পোষাক পরা মানুষগুলো ছোট ছোট নৌকায় করে পাহাড়ের দিকেই আসছে। দুর থেকে নৌকায় বসা মানুষগুলোকে বরফের টুকরো মনে হচ্ছিলো আমার।



  কয়েক মুহর্তের মধ্যে পাহাড় বেয়ে উঠে এলো মানুষগুলো। আমরাও মিশে গেলাম তাদের ভীড়ে। উপরে তাকালাম আমি; মনে হলো হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে।

 ভ্যালেনটাইনের নেতৃত্বে সমবেত নারী-পুরুষেরা দুর্গে প্রবেশ করলো। খিলানের পর খিলান, থামের পর থাম পেরিয়ে সবাই বিশাল এক হলঘরে প্রবেশ করলো। ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে প্রমাণ সাইজের মোমবাতির সাহায্যে। মোমবাতিগুলো এতোবড়ো যে, দেখলে মনে ভয়ই ধরে যায়।

 ভ্যালেনটাইন হলঘরের দেয়ালে বিশাল বেদীতে গিয়ে উঠলেন। সবাই স্বমস্বরে বলে উঠলো-‘রাজা ভ্যালেনটাইনের জয় হোক।’

 ‘ভ্যালেনটাইনের সকল অধিবাসী দীর্ঘজীবি হোক।’ প্রতিউত্তরে বললেন তিনি।

  একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন তিনি, ‘বন্ধুরা, আজ আমরা আরো একবার উৎসবের জন্য এখানে সমবেত হয়েছি। আপনারা জানেন আমাদের উৎসবের উপলক্ষ্য কি। নতুন একজন অতিথি ভ্যালেনটাইনের অধিবাসী হবার গৌরব অর্জন করেছেন। আর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করার জন্যই আমাদের উৎসব, যা নতুন কোনো অধিবাসীর জন্য আমরা প্রত্যেকবার করে থাকি।’

  এবার অবাক হবার পালা আমার; এতোগুলো মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে শুধু আমার জন্য!

     ‘বন্ধুরা, এবার আমি আমাদের অতিথিকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। রাহাত, এখানে এসো।’ আমাকে ডাকলেন ভ্যালেনটাইন।

  মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে বেদীতে গিয়ে উঠলাম।

 ভ্যালেনটাইন আমাকে ডানহাতে একটি ব্রেসলেট পরিয়ে দিলেন। ‘এ হচ্ছে রাহাত, ভ্যালেনটাইনের নতুন সদস্য।’ বললেন রাজা, আবারো করতালি।

  ‘এই ব্রেসলেট তোমাকে লোকজনের মধ্যে আলাদা একটা পরিচিতি দেবে। মানুষ এটা দেখলে জানবে যে এখানে তুমি নতুন। তবে কিছুদিনের মধ্যে আপনা থেকেই এটা খুলে পড়ে যাবে।’

  ‘ভালোবাসার পৃথিবীতে স্বাগতম।’ লোকজন একযোগে বললো।

 ‘বন্ধুরা,’ বিশাল হলঘরে গমগম করে উঠলো রাজার গলা, ‘আমাদের রীতি অনুযায়ী নতুন অতিথিকে বিশেষ একটি উপহার দেওয়া হয়। রাহাতের জন্যও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবার আমি ওকে বিশেষ সেই উপহারটি দেবো।’ তারপর তিনি রানিকে ডাকলেন, ‘রানি, ওকে নিয়ে এসো।’

 আমি অপেক্ষায় ছিলাম দেখার জন্য কি হতে পারে সেই বিশেষ উপহার। তবে সেটা যে আমার জন্য এতোটাই বিশেষ সেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো। রাণীর পিছন থেকে যে মুখটি উঁকি দিলো, সেই মুখটি আমার অসম্ভব প্রিয়। আমার মনপুরের বাসিন্দা সে, আমার কল্পনার রাণী, আমার জীবনের সবচাইতে আরাধ্য অধ্যায়, সবচাইতে সুন্দর সময়ের সাথী;-নুর।

 স্রেফ পাথর বনে গেলাম আমি। এতোটাই ধাক্কা খেলাম যে অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলামনা। তারপর মনের গভীর থেকে এক দারূন ব্যথা দলা পাকিয়ে উঠে এলো গলা বেয়ে। সেটা বিস্ফেরিত হয়ে যদি বের হয়ে আসতো তাহলে বোধহয় ভালোই হতো।

   কিন্তু এলোনা, ওটা আমাকে ভেতর থেকে ভাঙতে লাগলো। এ মুখ অনেকদিন দেখা হয়নি আমার, যে মুখের ছবি দিন-রাত, শয়নে-স্বপনে আঁকতো আমার মন।

  এ সেই মুখ যা আমার জীবন-দর্পন ছিলো। কিন্তু অনেকদিনের অব্যবহারে সেই দর্পন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। তবে কখনোই আমার মন থেকে সরেনি একপলকের জন্যও।

  আজ আবার তাকে দেখে আমি নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। এতোক্ষণ খুব কষ্ট হচ্ছিলো; গোঙানীর মতো আওয়াজ বেরুচ্ছিলো মুখ দিয়ে। অবশেষে মুক্তি মিললো, কষ্টের অবসান ঘটলো অশ্র“পাতের মাধ্যমে।

  আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো নুর, যখন দেখলো আমি কাঁদছি, দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর সেই সাথে সমবেত নারী-পুরুষেরা করতালির মাধ্যমে আমাদের অভিনন্দন জানালো।

  আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম, ধরেই থাকলাম। মনে হতে লাগলো হাজার বছর পর আবার সুখের বারিধারা বইতে লাগলো সারা অন্তর জুুড়ে।

 তারপর ওকে ছেড়ে দিলাম, আমার মনে প্রশ্ন জাগলো ও এখানে এলো কি করে? তার মানে ওও কি....., ভ্যালেনটাইনকে জিজ্ঞেস করলাম সে কথা।

  ‘হ্যাঁ, রাহাত, একটা রোড এক্সিডেন্টে স্বামী সহ মারা গেছে ও।’ তারপর তিনি জমায়েত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন-‘সমবেত বন্ধুরা, এবার আপনাদের উদ্দেশ্যে আমাদের অতিথিদ্বয়ের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।’ একটু থামলেন ভ্যালেনটাইন, দম নিয়ে আবার শুরু করলেন-‘রাহাত ও নুর একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। তাদের ভালোবাসা সত্যিকার অর্থেই খাঁটি ছিলো। রাহাতের উপর অনেক দায়িত্ব ছিলো, ওর পরিবার ওর উপর নির্ভরশীল ছিলো। তাছাড়া ওদের এই সম্পর্কে কারো সায় ছিলোনা। যে কারণে নুরের পিতা-মাতা যখন রাহাতের কাছ থেকে কোন জবাব পেলেন না, তখন তারা নুরের বিয়ে অন্যত্র দিয়ে দেন।

বিয়ের আগে ও রাহাতকে অনেক মিনতি করেছিলো ওকে নিয়ে দুরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু শুধুমাত্র পরিবারের কথা ভেবেই রাজী হলোনা রাহাত।

নীরবে নিভৃত্বে নুরের চলে যাওয়া দেখলো ও। আর ওর জন্য এক বুক ঘৃণা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলো নুর।

যারা ওদের সম্পর্কের কথা জানতো তারা রাহাতকে ধিক্কার জানালো। কিন্তু কেউ জানলোনা ওর মনের কথা।

 এটা সত্যি যে কাপুরুষের মতো ও পিছু হটেছিলো, কিন্তু কি অবস্থার শিকার হয়েছিলো তা কেউ বুঝলোনা।

  ওর বাবা মারা গেলেন, পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়লো ওর কাঁধে। এতোবড়ো সংসারের ঘাঁনি একাই টেনে নিয়ে গেলো ও। শত দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্চনা সহ্য করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলো।

  এতো কিছুর মাঝেও নুরকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি ও। আর এটাই আশ্চর্য যে, এতো বছর পরেও পর হয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য এই আর্তি আজকাল কেউ কি করে?

  আর এ জন্যই রাহাত আমাদের একজন। পৃথিবীর মানুষেরা সত্যিকার ভালোবাসা কাকে বলে ভুলে গেছে। তারা ভালোবাসার নামে নোংরা খেলায় মেতেছে। তাদের কাছে ভালোবাসা মানে জৈবিক চাহিদা।

  তবুও শত পংকিলতার মাঝেও চাঁদের মতো উঁকি দেয় পবিত্র প্রেম। আর যারা এর অংশীদার তারাই হয়ে যায় অমর। আমাদের রাহাত তাদেরই একজন।

  যদিও নুর ঘৃণা লালন করছিলো ওর জন্য, কিন্তু আসলে কখনো এক মুহুর্তের জন্য ওকে পর করতে পারেনি। ওর মনের গহীনে রাহাত ছিলো ওর মতোই।

  তাই বিধাতার ইচ্ছে অনুযায়ী রাহাত-নুর ভালোবাসার এ পৃথিবীর নতুন বাসিন্দা।’ এভাবে ইতি টানলেন ভ্যালেনটাইন।

 মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতোক্ষণ ওনার কথা শুনছিলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম, নিজের সম্পর্কে আমি যা জানি তারচেয়ে অনেক বেশি এরা জানে।

 

 ‘রাহাত,’ বলল নুর, ওর চোখে-মুখে অনুতাপ, ‘আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি। তোমার ভালোবাসা মহৎ ; আসলে ত্যাগই প্রকৃত প্রেম। পরিবারের জন্য তুমি নিজের ভালোবাসার নিলাম করেছো। কজন পারে এমনটি করতে? আমাকে তুমি মাফ করে দাও।’

 আমি কোন কথা বললামনা, বলার আছেই বা কি? ওকে দেখে সম্পূর্ন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি আমি।

 ‘বন্ধুরা, এবার আমরা ভোজের জন্য মিলিত হবো ভোজঘরে।’ বলে মিলনমেলার আপাত ইতি টানলেন ভ্যালেনটাইন। তারপর আমাকে বললেন-‘রাহাত, তুমি আর নুর আমাদের সাথে বসবে।’

 বিশাল হলঘর কয়েক মিনিটের মধ্যে খালি হয়ে গেলো। সবাই ভোজঘরে চলে গেলো।





খাবারের আয়োজনটা একদমই আলাদা। হলঘরের চেয়েও বিশাল ভোজকক্ষ। নানান রঙের কার্পেট বিছানো হয়েছে মেঝেতে। আর তার     উপরই বসেছে সকল নারী-পুরুষ। একটা লাল কার্পেটের উপর আমরা চারজনজন একসাথে- আমি, নুর, ভ্যালেনটাইন এবং রানী।

  খাবারের মেনু একই, যেরকম খেয়েছিলাম ফরহাদের বাড়িতে। তবে সম্পূর্ন অন্যরকম একটা আইটেম দেখলাম, যেটা ফুল দিয়ে মোড়া। জিজ্ঞেস করলাম কি ওটা।

  ‘ফুলগুলো সরিয়ে ফেলো, নিজেই দেখে নাও।’ বললেন রানী।

ফুল সরাতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম, একটা খুব সুন্দর কেক, তবে সচরাচর যেরকম দেখেছি মোটেও সেরকম নয়। ওটার গায়ে সোনালী হরফে লেখা-‘‘তোমাদের ভালোবাসা অমর হোক।’’

‘চমৎকার।’ বলল নুর।

 ‘এটা বানানো হয়েছে বিভিন্ন ফলের মিশ্রণ থেকে। প্রথমে ফলগুলো একত্রে পেষন করা হয়, তারপর হিমাগারে রাখা হয়। ওখান থেকে বের করে বানানো হয় এই কেক। তোমাদের জন্য আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে এটা উপহার।’ বললেন ভ্যালেনটাইন।

  ‘ধন্যবাদ।’ বললাম আমি।

 খেতে খেতে আমি ভ্যালেনটাইনের কাছে জানতে চাইলাম তার সম্পর্কে। বললাম পৃথিবীতে শুধূ তার সম্মানেই প্রেমিক-প্রেমিকারা পালন করে ভ্যালেনটাইনস ডে।

 ‘আমি জানি রাহাত, পৃথিবীতে আমার নামে বিশেষ একটি দিন পালন করে মানুষেরা। শুনতে চাও আমার জীবনের সেই স্মরণীয় ঘটনা?’

 ‘অবশ্যই।’ একযোগে বললাম আমি আর নুর।

 ‘সেটা ছিলো তৃতীয় শতাব্দীর কথা। প্রাচীন রোম নগরীতে বসবাস আমার। রোম তখন শাসিত হতো ক্লডিয়াস নামক এক নিষ্ঠুর শাসক কর্তৃক। আমি ক্লডিয়াসকে পছন্দ করতাম না, শুধু আমি না আরো অনেকেই আমার সাথে একমত পোষণ করতো।

ক্লডিয়াসের বিশাল সৈন্য বাহিনী ছিলো। সে চাইতো মানুষ তার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিক। কিন্তু অনেক মানুষ যুদ্ধ করতে পছন্দ করতোনা।

  সুতরাং বুঝতেই পারছো, অনেকেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে রাজী হতোনা। এটা ক্লডিয়াসকে রাগান্বিত করে। তো কি ঘটল?

  তার মাথায় এক উন্মাদসম বুদ্ধি খেলে গেলো। তিনি চিন্তা করলেন মানুষের যদি কোন পিছুটান না থাকে, তাহলে তারা যুদ্ধে যেতে অমত করবেনা। আর তাদের পিছুটান হচ্ছে তাদের স্ত্রী।

 তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন-তার রাজ্যে কাউকে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হবেনা।

 যুবকেরা ভাবলো, এ আইন সম্পূর্ন নিষ্ঠুর। আর আমার মনে হলো- এটা সম্পূর্নরুপেই অযৌক্তিক একটা সিদ্ধান্ত। আর কখনও আমি এ আইন সমর্থন করবোনা।

  ও, তোমাকে বোধহয় বলা হয়নি, আমি ছিলাম একজন যাজক। আমার প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিলো যুগলদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা।

  এমনকি ক্লডিয়াস তার নতুন আইন পাস করার পরও আমি আমার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। গোপনে, অবশ্যই।

  সেটা ছিলো খুবই রোমাঞ্চোকর। মোমবাতির আলোয় আলোকিত ছোট্ট একটা ঘরে আমরা তিনজন। বর, কনে এবং আমি। যখন সৈন্যদের পদশব্দ শুনতে পেতাম, তখন উৎসবের বাক্যগুলো আমরা ফিসফিস করে উচ্চারণ করতাম।

 এক রাতে আমরা তাদের পদশব্দ শুনতে পেলাম। উফ্, কি ভয়ংকর ছিলো সেই সময়টা। খোদাকে ধন্যবাদ, ঠিক সেই সময়ই এক যুগল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর চলে গিয়েছিলো।

  আমি ধরা পড়লাম। আমাকে জেলে নিক্ষেপ করা হলো এবং বলা হলো-ক্লডিয়াসের আইন অমান্য করায় আমার শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

  জেলের বিষাদময় দিনগুলো আমি আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করতাম। তোমরা কল্পনাও করতে পারবেনা, জেলের ভেতর কি দারূন ঘটনা ঘটেছিলো।

  সেলে যুবক-যুবতীরা আমাকে দেখতে আসতো। তারা জানালা দিয়ে ফুল এবং চিরকুট নিক্ষেপ করতো। আমাকে জানাতে চাইতো যে- তারাও ভালোবাসায় বিশ্বাস করে।

  তাদের মধ্যে একজন ছিলো কারারক্ষীর মেয়ে। তার পিতা তাকে আমার সাথে দেখা করতে দিতো। জেলের মধ্যে বসে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। সে আমাকে প্রেরণা জোগাতো। ক্লডিয়াসের আইন অমান্য করাকে সে সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করতো এবং আমার গোপনে বিয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়াকে সে সমর্থন করতো।

  আমার মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে এলো। যেদিন আমি মারা যাচ্ছিলাম, সেদিন আমার সেই বন্ধুকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। ভালোবাসায় ভরা চিঠিটার ইতি টেনেছিলাম এইভাবে-‘তোমার ভালোবাসার ভ্যালেনটাইন।’

  আমি বিশ্বাস করি- আমার পাঠানো সেই বিদায় সম্ভাষণটিই পরবর্তীতে ভ্যালেনটাইন’স ডের অবতারণা করে যা মানব-মানবীর মধ্যে ভালোবাসার বার্তা প্রেরনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

   এটি লেখা হয়েছিলো ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখ ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে; যেদিন আমি মারা যাচ্ছিলাম।’ একটু থামলেন ভ্যালেনটাইন, তারপর আবার বললেন-‘এখন পৃথিবীর মানুষেরা প্রতি বছরের এই দিনটিকে আলাদাভাবে পালন করে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই- লোকে বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবেই দিনটাকে স্মরণ করে।

   আর রাহাত, আমি মনে করি, যখন তারা এই দিনটাকে পালন করবে, তাদের মনে পড়বে শাসক ক্লডিয়াসের কথা। তাদের আরো মনে পড়বে কিভাবে সে ভালোবাসার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলো। তখন তারা হাসবে, কারণ- রাহাত, ভালোবাসা কখনও পরাজিত হতে পারেনা।’

  মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম ভালোবাসার এমন এক কাহিনী, যা যুগ যুগ ধরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। জানতাম না এতোটাই হৃদয়গ্রাহী সেই কাহিনী।

    ‘সেই কারারক্ষীর মেয়েটাই কি আমাদের রানী, সেইন্ট ভ্যালেনটাইন?’ প্রশ্নটা করল নুর।

  উত্তর দিলেন না রাজা, মুচকি হেসে তাকালেন রানীর দিকে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করলেন রানী।

 উত্তর পেয়ে গেলাম আমরা।

  ‘সেইন্ট ভ্যালেনটাইন,বুঝতে পারছি, কেন এত থাকতে আপনাকেই রাজা বানানো হলো।’ বললাম আমি।

  ‘না, রাহাত, এখানে রাজা বলে কোন কথা নেই। লোকেরা আমাকে সম্মান দেয়, এজন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমি।’ বললেন ভ্যালেনটাইন, একটু থেমে আবার বললেন ‘যাক, এবার শুনো রাহাত, আমি চাই খুব জলদি তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। তোমাদের কি অভিপ্রায়?’

  নুরের দিকে তাকালাম আমি, দেখলাম ও মাথা নিচু করে আছে। লজ্জা

পেয়েছো হয়তো। ‘কি নুর, লজ্জা পেলে?’ জিজ্ঞেস করলেন রানী, একটু আগেই যিনি লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলেন। এটাই হয়তো ওদের সবচাইতে বড়ো সম্পদ, ভাবলাম আমি।

  ‘ঠিক আছে, কালই তোমাদের বিয়ের আয়োজন করে ফেলবো। তারপর তোমরা দুজন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।’ বললেন রাজা।



                                  পাঁচ



  মুসলিম রীতি অনুযায়ীই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। একজন মাওলানা  বিয়ে পড়ালেন। প্রাসাদের মিলনকক্ষে রাজা-রানী নিজে উপস্থিত থেকে আমাদের আশীর্বাদ করলেন। মালা-বদলের সময় তিনি বাইবেল থেকে শ্লোক পাঠ করলেন। আমার মনে হলো, আমরা সেই প্রাচীন যুগে ফিরে গেছি, যখন ভ্যালেনটাইন ক্লডিয়াসের আইনের তোয়াক্কা না করে যুগলদের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করতেন।

   শ্লোক শেষ হবার পর ভ্যালেনটাইন আমাদের দুজনের মাথায় হাত রেখে বললেন-‘যে কাজটা করার কথা ছিলো তোমাদের বাবা-মার, সেটা করতে হচ্ছে আমাকে। তবে তারা যেখানেই থাক তাদের দোয়া তোমাদের কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে। আমি আশীর্বাদ করছি, তোমরা সুখী হও।’ একটু পর তিনি আবার বললেন-‘একটি দ্বীপে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাল তোমরা সেখানে পৌঁছে যাবে। আমি নিজে তোমাদের জন্য এই দ্বীপটা পছন্দ করেছি। খুব সুন্দর রাহাত, আশা করি মধুচন্দ্রিমা অনেক সুন্দর কাটবে তোমাদের।’

  আমার মনে পড়লো সেই দ্বীপটার কথা যেখানে শিরি-ফরহাদ থাকেন। সেটার চেয়েও কি সুন্দর হবে এটা? ভাবলাম।

  রানী আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন, গাঢ় স্বরে বললেন-‘নুর, তোমাকে বলছি-নিজেদের মধ্যে কখনও ভালোবাসার কমতি হতে দেবেনা। সবসময় মনে রাখবে, ভালোবাসা হচ্ছে একটি ফুলের গাছ। যাকে পরিচর্যা করতে হয়, সবসময় পানি দিতে হয়। আর আমি আশা করবো এই কাজে তোমরা কখনও গাফিলতি করবেনা। কখনও যেন অবহেলায় এই গাছ শুকিয়ে না যায়।’

   রানী আমাদের দুজনকে বাসরঘরে দিয়ে  এলেন। দেখে আমাদের দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ। পৃথিবীর সব ফুল যেন এই চারদেয়ালের মধ্যে জড়ো করা হয়েছে। সারা ঘরে ফুলের সমারোহ তো রয়েছেই, খাটটিও আগাগোড়া মোড়ানো ফুল দিয়ে। ‘ওমা, এত্তো ফুল!’ বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল নুর।

  ‘এই গ্রহে এই জিনিসটা অফুরন্ত নুর, যেখানেই যাবে, এর ছড়াছড়ি দেখবে। আর গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের বিয়েতে তো ফুলের সমাহার ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’ বললাম আমি।



তারপর আমরা ফুলশয্যায় বসলাম। আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা আমার নুর আবার আমার জীবনে ফিরে এসেছে, এবং এসেছে  চিরসাথী হয়ে।

  ‘বলোতো, আজকের এই রাত আমাদের জীবনে আসবে এটা কি তুমি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলে?’ জিজ্ঞেস করলো নুর, ওকে বিয়ের সাজে সাজানো হয়েছে। সচরাচর দেখেছি বিয়ের শাড়ি লাল, কিন্তু নুরকে সাজানো হয়েছে নীল শাড়িতে। ওকে দেখাচ্ছে আকাশে ঝুলে থাকা ঠিক ওই নীল চাঁদটির মতো। তবে কোন অলংকারে অলংকৃত করা হয়নি ওকে। তার জায়গায় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ওকে দেখতে দেখতে আমার মনে হলো- ওর চেয়ে সুন্দর কেউ, কখনো, কোথাও জন্ম নেয়নি; নেবেও না। তা সে পৃথিবীতেই হোক বা অন্য কোথাও।



  ‘কি দেখছো, রাহাত?’ লাজরাঙা স্বরে বলল নুর।

‘দেখছি আমার জীবন-দর্পন, যা অনেকদিন দেখা হয়নি। আচ্ছা নুর, তোমার কি সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে, সেই যে স্কুলের, কলেজের...’

‘ ভুলেও কখনো সেই দিনগুলোর কথা ভুলিনি আমি। চাইলেও ভুলতে পারিনি।’

হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। নুর অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে, বলল-‘অমন করে হাসছো যে?’

‘সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো, সেই যে, ঈদের দিন, তুমি আমাদের বাড়িতে এলে। তোমাকে একা পাবার জন্য আমার সেকি আকুতি। কিন্তু তোমার বোন ছায়ার মতো পিছে লেগেছিলো। শেষে তার চোখ এড়িয়ে উপরের ঘরে গেলাম আমরা...’

‘আর আমাকে একা পেয়ে তুমি গুন্ডামী শুরু করে দিলে’, কথা কেড়ে নিয়ে বললো নুর।

‘গুন্ডামী নয় নুর, ভালোবাসা। পুরো এক সপ্তাহ তোমাকে দেখিনি আমি। সেই দিন তোমাকে কাছে পেয়ে আমার কেমন লেগেছিলো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবোনা।’

‘আর তোমার সেই ভালোবাসা আমাকে এলোমেলা করে দিয়েছিলো। তার নিশান আমার গালেও লেগেছিলো।’

‘সেই নিশান তোমার সব বান্ধবী সহ তোমার বোন দেখেছিলো।’

‘আর সবাই হো হো করে হেসেছিলো, ঠিক যেমন করে তুমি এখন হাসলে।’ কপট রাগে মুখ ফেরাল নুর।

  বুঝলাম আমাকে এখন ওর মান ভাঙাতে হবে। ওর চিবুক ধরে মুখটা ফেরালাম, তারপর বললাম-‘এই চাঁদ মুখ ফিরিয়ে রেখোনা, বলোতো কতোদিন দেখিনা এই মুখ। আজকের রাতের আঁধার আমি চাই তোমার চাঁদ মুখের আলোয় আলোকিত হোক। মুখ ফিরিয়ে রেখোনা, নুর। আমাকে দেখতে দাও। তুমি জানোনা তোমাকে হারিয়ে আমার জীবনটা কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো। সারাটা জীবন নিজেকে ঘৃণা করেছি আমি, তোমার সাথে বেঈমানী করার জন্য। যখন একা থাকতাম তখন আমার জীবনের খাতা উল্টে দেখতাম, আর তখনই বুঝতাম, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনকিছুই নেই। তোমার সাথে কাটানো এক একটি ক্ষণ ছিলো আমার জীবনের এক একটি সেরা অধ্যায়। বিশ্বাস করো, শুধূমাত্র পরিবারের কথা চিন্তা করে আমাকে পিছু হঠতে হয়েছিলো।’ শেষের দিকে কেঁপে গেল আমার গলা।

 আমার ডাকে সাড়া দিল ও, দেখলাম ওর চোখে জল, আমার গলা জড়িয়ে ধরল , বলল-‘আর বলোনা রাহাত, আর বলোনা। আমি কোন কথা আর শুনতে চাইনা। আমাকে ভালোবাসা দাও। ভরিয়ে দাও আমার পৃথিবী।’

  যেই কাহিনীর ভিত পৃথিবীতে রচিত হয়েছিলো , তা পূর্ণতা পেলো  ভ্যালেনটাইনে। পৃথিবীর চেয়ে হাজারগুন সুন্দর একটি গ্রহে আমাদের বাসর হলো। মিলন হলো মনের সাথে মনের, শরীরের সাথে শরীরের।

 ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা। দুজনেই ক্লান্ত, তৃপ্ত।

 



   গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। সারা দেহ-মনে তৃপ্তি। সেই সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলো; কেউ জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলো আমাকে। ‘এই উঠো, আর কতো ঘুমাবে, বেলা অনেক হয়ে গেছে। আরে উঠোতো’ নুর ডাকছে আমাকে।

   চোখ মেললাম, আর সেই সাথে বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। নুর নয়, আমার মুখের উপর ঝুঁকে থাকা মুখটিকে চেনা মনে হলো। খানিক চেয়ে রইলাম ওর দিকে। ভালো করে দেখতেই চিনতে পারলাম। আমার কাজের লোক হাশেম। কিন্তু ও এখানে কি করে এলো? তারমানে সেও কি মারা গেছে?

   ‘আল্লাই আমারে বাঁচাইছে, শেষ পর্যন্ত চোখ খুললেন আফনি?’ আমাকে চোখ মেলতে দেখে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো হাশেম।

   ‘হাশেম, তুমি এখানে কি করছো? কি করে এলে এখানে?’ ধরমর করে উঠে পড়েছি আমি, দ্রুত জিজ্ঞেস করলাম ওকে।

   ‘কি কন, না কন সাব, আফনের ঘরে আমি আমুনা তো কে আইবো?’ বলল হাশেম, চোখে অবাক দৃষ্টি।

   ‘আমার ঘর? তোমার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।’ হঠাৎ আমার মনে পড়লো নুরের কথা, দ্রুত বলে উঠলাম-‘নুর কোথায়, হাশেম?’

   ‘নুর? হে আবার কেডা?’

  তারমানে হাশেম জানেনা নুর কে। কি মনে করে আমি ঘরের চারিদিকে তাকালাম, এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, ঘরটা আমার অতি পরিচিত, এখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে আমার। কাল রাতের ফুলে ভরা বাসর ঘর নয়, আমি পৃথিবীতে আমার নিজের ঘরেই আছি! কিন্তু এ কি করে হয়?

  ‘হাশেম, এটা ভ্যালেনটাইন নয়? আমি কোথায় আছি?’

  ‘সাব আফনে কি পাগল হয়ে গেলেন? গত রাত্রে আফনি বারান্দায় বইসা ছিলেন। বৃষ্টি পড়তেছিলো, আমি গিয়া দেখলাম আফনি একমনে বইসা আছেন, তাই আফনেরে বিরক্ত করিনাই। বেশি রাত অইয়া যাওনের পরও আফনেরে ঘরে না দেইখা আমি বারান্দায় গিয়া দেহি, আপনি মেঝেতে পইরা আছেন। পরথমে তো ভয়ই পাইয়া গেছিলাম। ভালো করে পরীক্ষা করে দেহি, না আফনি ঠিক আছেন। বইসা থাকতে থাকতে ঘুমাইয়া পড়ছিলেন।’

   ‘তারপর?’ দ্রুত জিজ্ঞেস করলাম।

  ‘তারপর আর কি, কোলে কইরা নিয়ে আসলাম আফনেরে। বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বাপরে বাপ, যেই ঘুম দিলেন। হেই কহন থেইকা  ডাকতেছি, আফনের ঘুমই ভাঙেনা। সাব, আমার এই সব আর ভালা লাগেনা, আপনি শাদী করেন। এই ভাবে কোন মানুষের জিন্দেগী কাটেনা।’ হাশেমের গলায় অভিযোগ। ‘মুখ ধুইয়া আহেন, আফনের নাস্তা দিতাছি’ বলে চলে গেলো ও।

  তারমানে কালরাত থেকে এর আগের ঘটনাগুলোা পুরোটাই একরাতের স্বপ্ন! দারুন হতাশ হয়ে ভাবলাম আমি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলামনা যে ঘটনাগুলো স্বপ্নই ছিলো।

  চোখের সামনে ভাসতে লাগলো চমৎকার সব ঘটনাগুলো। নদীর চরে শিরি-ফরহাদের সাথে পরিচয়, চমৎকার ঘর। ওদের বাড়িতে রাত কাটানো,

তারপর ওখান থেকে রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদে যাওয়ার সময় স্বর্ণাক্ষরে লেখা বানীর কথা মনে পড়লো-‘ভালোবাসলে ভালোবাসাকে পেতেই হবে, এরকম

  কোন কথা নেই। এমন অনেক ভালোবাসা হয়, যা প্রতিদান চায়না।’

রাজা ভ্যালেনটাইন, রানীর সাথে পরিচয়। তারপর উৎসবের রাত, এবং.. এবং..., নুর।

  প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম নুরের নাম ধরে। কি ভেবে থেমে গেলাম।

  ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম- আসলেই কি যা ঘটেছিলো তা সত্যি? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই আমার কল্পনা? এমনকি নুরের সাথে আমার বিয়ে এবং মধুর রাত, সবই মিথ্যে?

  ভালো করে ভাবতেই পরিষ্কার হয়ে গেলো সব। ভ্যালেনটাইন নামে কোন গ্রহের অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারেনা। যদি থাকতো তাহলে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই তার হদিস বের করে ফেলতেন। আসলে নুর আমার মনের মধ্যে এভাবে তার আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছে যে, ওকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা নিখাদ, এই ব্যাপারটা নিজের কাছে নিজেই প্রমাণ করার জন্য আমার মন এরকম একটা অবাস্তব পৃথিবী সৃষ্টি করে নিয়েছে, যে পৃথিবীর নাম ভ্যালেনটাইন। যার অধিবাসীরা সবাই নিজেদের ভালোবাসার জন্য অমর হয়ে আছেন। আমিও নিজেকে সেই স্বপ্নপুরের অধিবাসী করে নিয়েছি, শুধুমাত্র নিজের কাছে নিজেই পরিষ্কার থাকার উদ্দেশ্যে। আমার ভালোবাসা যে মিথ্যে ছিলোনা, এটা নিজেই নিজেকে বোঝানোর জন্য।

  ব্যাখ্যাটা গ্রহনযোগ্য; না গ্রহনযোগ্য নয়, এটাই সত্যি। কিন্তু আমার মন কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে চাইলোনা, যে সবকিছুই মিথ্যে।

  কারো সাথে ব্যাপারটা নিয়ে ডিসকাস করলে কেমন হয়? সাইকিয়াট্রিস্ট মারুফকে বললে?

  চিন্তা করে দেখলাম- মারুফ আমাকে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবে। ওর জায়গায় আমি হলেও তাই মনে করতাম।

  তারমানে, যা ঘটেছে তা সবই আমার কল্পনা, ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। আর সেই সাথে দারুণ হতাশা নিয়ে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য।



  আয়নায় নিজেকে দেখে আমার ব্যাখ্যাটা আরো বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। আমার পরনে কালরাতের গাউন। ভ্যালেনটাইনের পোষাক সাদা জোব্বা নয়। নিজেকে তিরষ্কার করলাম - এখনো আমি নিজেকে ভ্যালেনটাইনেই কল্পনা করছি।

  তারপর মুখ ধোয়ার জন্য হাত মুখের কাছে নিতেই জমে গেলাম বরফের মতো। আমার ডানহাতে একটা ব্রেসলেট, নীল রঙের!

  বিদ্যুত চমকের মতো মনে পড়ে গেলো ব্রেসলেটটা কি করে আমার হাতে এসেছিলো- ভ্যালেনটাইন নিজহাতে আমাকে এটা পরিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন-‘এটা তোমাকে এই গ্রহে আলাদা একটা পরিচিতি দেবে।’

  এখন! এখন তাহলে কি দাঁড়ালো? এখন কি করে বলবো যে সবকিছুই মিথ্যে? মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার।

  বেডরুমে চলে এলাম । গোড়া থেকে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম আবার। মিলাতে চেষ্টা করলাম বাস্তব আর কল্পনা।

  এমনিতে আমার কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলোনা, পুরো ব্যাপারটা মিথ্যে। কিন্তু যু্িক্ত দিয়ে চিন্তা করে দেখলে মিথ্যে বলে মেনে নিতেই হয়, নিয়েছিলামও। সব গড়বড় করে দিলো ওই ব্রেসলেটটা। এটা তো আর মিথ্যে হতে পারেনা। তাহলে?

                               

                                       ছয়



   এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। সেই সকালটা আমার জীবনে নতুন এক মোড় নিয়ে এলো। সব গ্লানি, সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে আবার আমি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার এই পরিবর্তনে আমার ঘনিষ্ঠজনেরা অবাক এবং খুশি। তারা আমাকে এই রুপেই দেখতে পছন্দ করে। হাসি-খুশি, উদ্যমী এবং সফল।

   সবচাইতে বেশি অবাক হলো মারুফ। বলে-‘কি এমন যাদুর কাঠি যা তোকে এতোটাই বদলে দিলো।’

 জবাবে আমি রহস্যময় হাসি দেই একটা। বলি-‘আছে একটা, তবে তোকে বলা যাবেনা।’

  ‘কোন নারী নিশ্চয়ই?’ উৎসুক দৃষ্টি হেনে জানতে চায় ও।

  ততোধিক রহস্যময় হাসি হেসে প্রস্থান করি আমি। ওকে বলার প্রশ্নই আসেনা।

  শুধু ওকে না , কাউকেই বলিনা আমি। সবাই আমার কাছে জানতে চায়, এতো সুন্দর এই ব্রেসলেটটা আমি কোথায় পেলাম। জবাবে বলি-‘আমার এক বন্ধু সিঙ্গাপুর থেকে পাঠিয়েছে।’

  আমার এই পরিবর্তনের কারণ এই ব্রেসলেটটাই। অনেক ভেবে দেখেছি আমি। আমার জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ওই ঘটনাগুলো মিথ্যে ছিলোনা। সত্যিই ভ্যালেনটাইন নামে একটা গ্রহ আছে, যেখানকার অধিবাসিরা সবাই ভালোবাসার জন্য ইতিহাস হয়ে আছেন। অসাধারণ কতোগুলো সময় ওখানে কেটেছে আমার। এই জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

   মন থেকে ভালোবেসেছিলাম বলেই ওখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। আর এই খাঁটি ভালোবাসার কারণেই নুর, আমার ভালোবাসাকে নতুন করে পাই। যদিও তা ক্ষনিকের জন্য, তবু তাতে কি? আমার মনে তো ও আছে ওর মতোই।

  এই কথাগুলো কাউকেই বলিনা। কারণ-বললে কেউ বিশ্বাসই করবেনা। তারচেয়ে এই ভালো। সত্যটা কেবল আমিই জানলাম।



  প্রায় প্রতিরাতেই ব্রেসলেটটা আমি দেখি। আর ভাবি ভ্যালেনটাইন নামে সেই পৃথিবীর কথা। পৃথিবীর চেয়ে হাজারগুন সুন্দর, অন্য এক পৃথিবী।

                                 *********





   









                  





  







                                                    



No comments: