মারুফ সাহেবের হাতে খবরের কাগজ। কিন্তু তিনি পড়ছেননা, শুধু ধরে আছেন। বাড়ীতে কেউ নেই,
তিনি একা। তার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। এতোবড় বাড়িতে একা থাকা এমনিতেই বোরিং , তার উপর তিনি ভীষন বিচলিত। তার পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে এতোটা বিচলিত তিনি কখনও বোধ করেননি।
জীবনের এতোটা সময় কোন ঝামেলা ছাড়া পার করে এই শেষ বেলায় এসে এতোটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যাবেন, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
মারুফ সাহেবের বয়স পঁয়তাল্লিশ হলেও দেখে তাকে মোটেও সেরকম মনে হয়না। নিয়মিত ব্যায়াম করেন তিনি। জুলফিতে খানিকটা পাক ধরেছে, ডাই করে তিনি সেটা ঢেকে রাখেন। হাইট পাঁচ ফিট আট। তার চোখ দুটিতে রাজ্যের মায়া। মোটকথা, দেখে তার বয়স ত্রিশের বেশি মনে হয়না।
মারুফ সাহেব জনপ্রিয় অ্যাডমেকার। তার অনেকগুলো ব্যাবসার মধ্যে বিজ্ঞাপন নির্মান একটি। তবে এটাকে তিনি ব্যাবসা মনে করেননা, শিল্প হিসেবে দেখেন। তিনি তার রুচির বহিপ্রকাশ ঘটান বিজ্ঞাপনগুলোতে। যে কারনে তার নির্মিত সবগুলো বিজ্ঞাপন দেশে বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইন্টারভিউ দেওয়ার কারণে লোকজনের মধ্যে তার চেহারাটাও বেশ পরিচিত।
মারুফ সাহেব যেখানেই যান তার ম্যাগনেটিক পার্সোনালিটি সবাইকে আকৃষ্ট করে। তার অধীনস্থরা সবাই তাকে টনিক মনে করে।
ব্যাক্তিগত জীবনেও তিনি সফল একজন মানুষ। দুই সন্তানের জনক তিনি। বড় ছেলে আমান আমেরিকার
ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। ছোট মেয়ে ফারাহ দেশে, ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে মাত্র। মেয়েকে তিনি খুব বেশী ভালোবাসেন বলে কাছছাড়া করেননি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি ছেলেকে ভালোবাসেননা। তবে মেয়ের প্রতি তার আলাদা একটা টান আছে। মেয়েও বাবার পাগল।
তার স্ত্রী আফসানা মেয়ের প্রতি তার এই আদরকে ভর্ৎসনা করেন, তবে মারুফ সাহেব সেটা গায়ে মাখেননা।
মারুফ সাহেবের সহধর্মিনী হবার মতো সমস্ত গুণই আফসানার মধ্যে আছে। তার অনেকগুলো গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি যে-কোনো সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। ঠান্ডা মাথায় যে-কোনো সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন তিনি। তাই সাংসারিক যে কোন ব্যাপারে মারুফ সাহেব স্ত্রীর উপর নির্ভর করেন নিশ্চিন্তে।
সব মিলিয়ে মারুফ সাহেব মোটামুটি সুখী একজন মানুষ। কিন্তু সেই সুখের ঘর বোধহয় ভেঙে যেতে বসেছে, রিচার্ড স্টিলির সেই বাণীর মতো;-‘সুখ হচ্ছে বেলা ভূমিতে গড়া বালুর মতো। যে কোন মুহুর্তে জোয়ারের পানিতে তা ভেসে যেতে পারে।’
ঘটনার সূত্রপাত প্রায় দুমাস আগে। তার অ্যাড ফার্ম ‘নদীয়া’য় একটা মেয়ে আসে। রিসেপশনে মেয়েটি সরাসরি তার সাথে দেখা করতে চায়। নদীয়া অ্যাড ফার্ম হলেও এর চেইন অব রুলস শক্ত। ডিরেকটরের কাছে যাওয়ার আগে অনেক সেকশন ডিঙাতে হয়। রিসেপশনিস্ট তাকে বুঝিয়ে বলে যে, সে যেনো তার কাগজপত্র জমা দিয়ে দুদিন পরে আসে। এর মধ্যে সে অ্যাপয়েন্টম্যান্ট করে রাখবে।
কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। সে দেখা করেই যাবে। অনেক তর্কাতর্কির পর মেয়েটা যখন সরাসরি রুমে ঢুকে পড়তে চাইল রিসেপশনিস্ট বাধ্য হল মারুফ সাহেবের কাছে ফোন করতে।
সব শুনে তিনি মেয়েটাকে রুমে আসতে বললেন। এর পরই তার জীবনে এমন এক মোড় নিল যেটাকে তিনি নিজেই সৃষ্টি করলেন।
‘মে আই কাম ইন, স্যার?’ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল মেয়েটা।
জড়তা এমন একটা জিনিস যেটা মারুফ সাহেবের মধ্যে কোন কালেই ছিলনা। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে
দু’কি তিন সেকেন্ড থ মেরে গেলেন তিনি। খুব অল্প বয়স মেয়েটার। বড়জোর সতের কি আঠার। কিন্তু যেটা প্রথম দেখায় মারুফ সাহেবের নজর কাড়ল সেটা হচ্ছে মেয়েটার চেহারা। অদ¢ুত নিষ্পাপ একটা ভাব ওর চেহারায়, ঠিক যেন একটা দেবশিশু।
দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলেন মারুফ সাহেব,একটু হেসে তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে বললেন-‘ এতোক্ষণ তো জোড় করেই ঢুকতে চাইছিলে, যাক, এসো।’
মেয়েটাকে বসালেন মারুফ সাহেব। তারপর বললেন- ‘তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল, বলে ফেলো কি জন্য এসেছো। আমাকে জরুরি একটা মিটিঙে যেতে হবে।’
‘সরি স্যার, ফাইভ মিনিটস আর নট এনাফ ফর মি,’ মারুফ সাহেবকে অবাক করে দিয়ে বলল মেয়েটা।
তার মুখের উপর সরাসরি না করে দেওয়ার আগে মেয়েটা এমনকি চিন্তাও করলনা। একটু চিন্তা করলেন তিনি, তারপর বললেন ‘ও.কে., মিটিং-ফিটিং বাদ, তোমার কথাই শুনবো আজ। তবে একটা কথা...’
‘বলুন স্যার।’
‘আমি নিশ্চিত যে, তুমি আমাকে তোমার লাভস্টোরি শোনাবেনা।’
খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা। বলল-‘ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড, স্যার,আমার কোন লাভার নেই ।’
‘ঠিক আছে, তাহলে বলে ফেলো, তবে আগে তোমার নামটা বলো।’
‘লুবনা।’
‘দ্যাটস আ নাইস নেইম। কিন্তু লুবনা, আমি যদ্দুর জানি তুমি মারা গেছো।’
‘মানে?’ চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল ওর।
‘হ্যাঁ, তুমি মারা গেছো এবং তোমার জন্য একজন লোক পুরো একটা আন্ডারওয়ার্ল্ড টিম ধ্বংস করে দিয়েছে।’
লুবনা হাঁ করে চেয়ে রইলো মারুফ সাহেবের দিকে।
‘কি, ভয় পেলে? ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি যে-লুবনার কথা বলছি সে তুমি নও। সে মাসুদ রানা উপন্যাসের অগ্নিপুরুষের লুবনা,’ বলে হো হো করে হেসে উঠলেন মারুফ সাহেব।
‘একটা কথা বলি, স্যার?’ একটু পর বলল লুবনা।
‘বলো।’
‘আপনি খুব সুন্দর করে হাসেন।’
‘এর পরে তুমি হয়তো বলক্ষে আমাকে হিরোর মতো দেখায়, চেষ্টা করলে আমি সিনেমায় ভালো করব।
এ সবই আমি জানি লুবনা। যেটা জানিনা সেটা হচ্ছে, তুমি কি জন্য এসেছো।’
‘আপনার সময় অপচয় করার জন্য দুঃখিত।’ একটু থামল লুবনা, তারপর বলল-‘আমি মডেল হতে চাই স্যার।’
একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন মারুফ সাহেব। বললেন-‘তুমি মডেল হতে চাও, না?’
‘জি, স্যার।’
‘কেন?’
থতমত খেয়ে গেল লুবনা। তবে মাত্র দু’সেকেন্ডের জন্য, দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-‘আমি জানি এবং আমি বিশ্বাস করি সুযোগ পেলে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারব।’
খানিক নীরবতা। মারুফ সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। একটু এগিয়ে গিয়ে লুবনার চেয়ায়ের কাছে গিয়ে টেবিলের উপর বসলেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘অনেক মেয়েই আসে আমার কাছে মডেল হওয়ার জন্য। সবাইকেই আমি এই প্রশ্নটা করি। যারা আমার মনের মতো উত্তরটা দিতে পারে কেবল তাদেরকেই আমি সিলেক্ট করি।’
‘আমি বোধহয় সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিনি, তাইনা স্যার?’ ভয়ে ভয়ে বলল লুবনা।
‘পেরেছো, শুধু তাই না, তুমি আমাকে বড় একটা ঝামেলা থেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছো। আমার নতুন অ্যাডের জন্য একটা আনকোরা নতুন মেয়ের দরকার ছিলো।’
‘দ্যাট মিনস আই’ম সিলেক্টেড?’ লুবনার গলায় চাপা উল্লাস।
‘ইয়েস, মাই ফেলো। কংগ্রাচুলেশন।’ হাত বাড়িয়ে দিলেন মারুফ সাহেব।
লুবনার চোখে তখন খুশির অশ্র“। দু’হাতে মারুফ সাহেবের হাতটা ধরল সে, বলল-‘আমি কৃতজ্ঞ স্যার।’
এরপরের কাহিনী শুধুই লুবনার, তবে সে কাহিনীর রচয়িতা মারুফ সাহেব। অডিশনে দারুণভাবে উতরে গেলো সে, তারপর যতেœর সাথে নির্মিত অ্যাডটি তুমুল সাড়া ফেলে দিলো। রাতারাতি সে পরিণত হলো ক্রেজে। খ্যাতির চূড়ায় উঠে গেলো সে। মারুফ সাহেবের সান্নিধ্যে এসে সে পেয়ে গেলো অমিত সুখের ঠিকানা। আর মারুফ সাহেব, তার কি হলো?
লুবনা আর মারুফ সাহেবের মধ্যে তৈরি হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বয়সের ব্যবধান বিস্তর, কিন্তু সেটা কোন প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ালনা। মারুফ সাহেব উদারমনা,এনার্জেটিক মানুষ। তার কাছাকাছি গেলে যে কোন চাপা স্বভাবের লোকেরও মনের আগল খুলে যাবে। লুবনা প্রথম থেকেই ছিলো ষ্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড
স্বভাবের। খ্যাতি তাকে অহংকারি করেনি বরং করেছে মার্জিত এবং বিনয়ী। সুতরাং একই মেরুর দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরী হতে সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু এই সম্পর্কই যে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, মারুফ সাহেব ঘুণাক্ষরেও তা কল্পনা করেননি।
প্রথমদিকে তাদের সম্পর্কটা ছিলো নির্ভেজাল বন্ধুত্বের। ধীরে ধীরে তা অন্যদিকে মোড় নিতে লাগলো।
বিশেষ একটা দিনে চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশ পেয়ে গেল তা। সেদিন ছিলো মারুফ সাহেবের জন্মদিন। প্রতি জন্মদিনেই তাকে ফ্যামিলির সবাই উইশ করে। বড় ছেলে আমান টেলিফোনে আমেরিকা থেকে, আর মা-মেয়ে ঘরে দেন বিশাল পার্টি। কিন্তু এবারের জন্মদিনটা সম্পূর্ন অন্যরকম হয়ে ধরা দেয় মারুফ সাহেবের কাছে। তার অফিসে ফোন করে লুবনা, বলে আধঘন্টার মধ্যে তিনি যেন ওর বাসায় যান। যতো ব্যাস্ত-তাই থাকুক লুবনার জন্য সময় বের করে নিতে মারুফ সাহেবের অসুবিধে হয়না। আধঘন্টার আগেই পৌঁছে যান তিনি। এবং গিয়েই মুখোমুখি হন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। মারুফ সাহেবকে বেডরুমে নিয়ে যায় লুবনা। ঘর তখন অন্ধকার ছিলো। লাইট জ্বালাবার পর মারুফ সাহেব দেখেন সারা ঘরে প্রচুর ফুল। এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই। ঘরের ঠিক মাঝখানে টেবিলের উপর বিশাল কেক। সেখানে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে টু মারুফ।’ সিডি প্লেয়ারে শাফিন আহমেদের ‘আজ জন্মদিন তোমার’ গানটি বাজছে।
মারুফ সাহেব তখন দারুন সারপ্রাইজড। বললেন ‘লুবনা, কি করেছো তুমি!’
‘কেনো, আমি করবো নাতো কে করবে?’
ভালো করে লুবনার দিকে তাকালেন মারুফ সাহেব। দেখলেন যেটা তিনি প্রথমে দেখেননি। লুবনা সেজেছে, এবং সেজেছে এমনভাবে যে কেউ তাকে দেখলে মনে মনে বলবে ‘একবার যদি মেয়েটাকে পেতাম।’
লুবনা বললো-‘কি, কেমন লাগছে আমাকে?’
শীতের সকালে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি, ভরা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে হাজারগুণ বেশি,সান্ধ্যাকাশে অস্তমিত সূর্যের লালিমার চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর তুমি, এই কথাগুলো বলতে চাইলেন মারুফ সাহেব, কিন্তু তার মুখ দিয়ে শুধু একটি কথাই বেরুল-‘অসাধারণ!’
এরপর কেক কাটা হলো। খানিক পর লুবনা বললো-‘জানতে চাইলেনা, কেন সেজেছি আমি?’
প্রশ্নটা যে মারুফ সাহেবের মনে উদয় হয়নি তা নয়। অন্য যেকোন দিনের লুবনার চেয়ে আজকের লুবনাকে কেন জানি অন্যরকম লাগছে তার। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারেননি। কেন যেন তার মনে হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে চরম সত্য। বললেন-‘কেনো আবার, আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে।’
‘হ্যাঁ, সেটা একটা একটা কারণ, তবে আরো একটা কারণ আছে, যেটা স্পেশাল।’
‘স্পেশাল?’
‘হ্যাঁ, এখন আমি যে কথাগুলো বলব তুমি তা মন দিয়ে শুনবে। বিশেষ একটি কথা বলার জন্য তোমাকে ডেকেছি আজ।’ একটু থামল ও, তারপর ধীরে ধীরে সময় নিয়ে বলল,- ‘ মারুফ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
ঘরের ভেতর যেন বোমা ফাটলো। বোমার রিএ্যাকশন কেটে যাবার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ।
মারুফ সাহেব আঁচ করতে পেরেছিলেন এমনই একটা কিছু বলবে ও। তারপরও তার অবস্থা এমন দাঁড়ালো, যেনো হাইওয়েতে ফুলস্পিডে ছুটে চলা কোনো গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছেন তিনি।
‘তুমি হয়তো বলবে অল্প বয়সের আবেগের বশে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ একটু থেমে আবার শুরু করল লুবনা-‘ অনেক ভেবেছি আমি , সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে চেয়েছি, পারিনি। তুমি জানো, মনের উপর জোর চলেনা। এবং সবশেষে মারুফ যে কথটি বলতে চাই, তুমি আমাকে রিফিউজ করবেনা। অবশ্য আমি জানি তুমি তা পারবেও না।’
চিন্তার ঝড় বয়ে চলেছে মারুফ সাহেবের মাথার মধ্যে। লুবনার অফার অ্যাকসেপ্ট করার পর কি ঘটবে কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি। তার অতি আদরের মেয়ে ফারাহ এবং সুখ-দুঃখের সাথী আফসানা
মনে ভীষণ আঘাত নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ছেলে আমান বাবার উপর ভীষণ ঘৃণা নিয়ে আর কখনও দেশে ফিরতে চাইবেনা। পত্রিকাগুলো তাকে নিয়ে মুখরোচক খবর ছাপাবে। খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা মারুফ সাহেব একটানে পতিত হবেন ডাস্টবিনে।
‘ল্বুনা, ’ বললেন তিনি ‘আমি জানি, তুমি যা বলছো বুঝে-শুনেই বলছো। ঠান্ডা মাথায় একবার আমার দিক থেকে চিন্তা করে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে...’
‘ভেবেছি’, কথা কেড়ে নিয়ে বললো লুবনা ‘ভেবেছি এবং সমাধানও বের করেছি।’
‘কি রকম?’
‘আমাকে তোমার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবেনা।’
থমথমে হয়ে গেলো মারুফ সাহেবের চেহারা, মায়াভরা মুখটায় রাজ্যের গম্ভীরতা নেমে এলো। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর জলদগম্ভীর স্বরে বললেন-‘শুনো লুবনা, আমার জীবনে পারতপক্ষে আমি কোনো অন্যায় করিনি, অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিইনি। যে সম্পর্কের কথা তুমি বলছ সমাজ সেটাকে কি নামে অভিহিত কেের জানো তুমি? রক্ষিতা বলে, রক্ষিতা!’ শেষের দিকে মারুফ সাহেবের গলা বেশ রাগান্বিত শোনালো।
‘তুমি আমার কথার ভুল অর্থ করছো, মারুফ। আমি ভালো করেই জানি সমাজে তোমার স্ট্যাটাস আছে। তাছাড়া তোমার ফ্যামিলি তো আছেই। সেজন্যই বলছি কেনো সামাজিক স্বীকৃতি আমার দরকার নেই।’
‘তাহলে?’
‘তুমি শুধু আমাকে তোমার মনে একটু জায়গা দিয়ো, ব্যস তাতেই আমার চলবে।’
মারুফ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন লুবনা কাঁদছে। পৃথিবীতে সবচাইতে কষ্টের দৃশ্য হচ্ছে সুন্দরী মেয়েদের কান্না। মারুফ সাহেবের হৃদয় ছুঁয়ে গেলো ওর কান্না।
তিনি বুঝতে পারলেননা এঅবস্থায় তার কি করা উচিত। বেশীক্ষণ দোটানায় ভুগবার অবকাশ রইলনা তার, কারণ লুবনার কান্নার বেগ বেড়ে গেছে। এগিয়ে গেলেন তিনি, ওর কাঁধে হাত রাখলেন।
সান্ত্বনাসূচক কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু সে সুযোগ তাকে দিলোনা লুবনা, ভীতা হরিণীর মতো ঢুকে পড়লো মারুফ সাহেবের বুকে। লুবনার ছোট্ট, কোমল শরীর মিশে গেলো তার শরীরের সাথে। একটু পরেই বডিল্যাংগুয়েজ বদলে গেলো ওর। মারুফ সাহেব মহাপুরুষ নন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন লুবনা জবাব আশা করছে। তার খুব ইচ্ছে করলো এক ধাক্কা দিয়ে লুবনাকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রিপুর কাছে পরাজিত হলেন তিনি। লুবনাকে জড়িয়ে ধরে তিনি যখন বিছানায় যাচ্ছিলেন তখন তার মনে হচ্ছিলো তিনি যেনো বিশাল এক খাদে পড়ে যাচ্ছেন, তবে পতন ঠেকাবার কোনো ইচ্ছা তার মধ্যে কাজ করছেনা।
সেই শুরু, মারুফ সাহেব সেই খাদ থেকে আর উঠতে পারেননি। একটু একটু করে তিনি লুবনাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। দায়িত্ববান আর সচেতন একজন মানুষ হিসেবে যিনি নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন, সেই মারুফ সাহেবই সবকিছু ভুলে ডুবে যান এমন একটি সম্পর্কে ,সমাজে যার পরিচিতি পরকীয়া নামে। প্রতিবার লুবনার সাথে শারীরিক সম্ভোগের পর তিনি দারুন অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। প্রতিবারই সিদ্ধান্ত নেন আজই এ অবৈধ সম্পর্কের অবসান ঘটাবেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কখনোই বাস্তবায়ন করা হয়না তার। লুবনার ভালোবাসা অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে রাখে তাকে। যতোই ছাড়াতে চেষ্টা করেন ততোই আরো শক্ত করে জড়াতে থাকে।
লুবনার ভালোবাসা কতোটা প্রভাব বিস্তার করেছে তার উপর তা তিনি বুঝতে পারলেন তখনই যখন কাজে ভুল করতে শুরু করলেন। তার এই অন্যমনস্কতা আফসানার চোখ এড়ায়না। মাঝে মাঝে আফসানাকে সব খুলে বলতে ইচ্ছে করে মারুফ সাহেবের। কিন্তু দারুন একটা ভয় তার কন্ঠরোধ করে দেয়। নিজের জীবনের বিনিময়েও তিনি আফসানাকে হারাতে চাননা। তাই বলতে চাইলেও বলা হয়ে উঠেনা।
কিন্তু মারুফ সাহেব এমনই একজন মানুষ যিনি সব বাধাকে ভেঙে-চুরে সামনে এগোতে পছন্দ করেন।
সিদ্ধান্ত নিলেন লুবনাকে বুঝিয়ে বলে এর যবনিকা টানবেন। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে অনেকটা ভারমুক্ত
হলেন তিনি। কিন্তু তখনো তিনি জানেননা জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ, ভয়ংকর, যন্ত্রণাকর সময়টা অপেক্ষা করছে সামনেই।
সে রাতটা ছিলো মারুফ সাহেবের জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। লুবনা বিছানায় তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। মারুফ সাহেব মনে মনে ভাবছেন কিরকম রিঅ্যাক্ট করবে লুবনা। নিশ্চয়ই মনে ভীষণ আঘাত পাবে। নিঃস্বার্থ ভাবেই তো ভালেবেসেছিলো ও মারুফ সাহেবকে। মনে মনে তৈরী হলেন তিনি।
‘তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো, লুবনা,’ মৃদু, কোমল গলায় বললেন তিনি।
‘তোমাকেও আমার কিছু বলার ছিলো মারুফ,’ জবাবে বললো লুবনা।
‘তাই নাকি?’ কিছুটা অবাকই হলেন মারুফ সাহেব, ‘ঠিক আছে, তুমিই আগে বলো।’
‘তুমি আমাকে বিয়ে করছো কবে?’ কোমল অথচ কঠিন গলায় বললো লুবনা।
মারুফ সাহেবের মনে হলো তিনি ভুল শুনেছেন। ‘কি বললে?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘বলছি আমাদের বিয়েটা হচ্ছে কবে?’ এবার বলার ভঙ্গিটা একদম স্বাভাবিক লুবনার।
মাথায় বজ্রপাত হলেও এতোটা অবাক হতেন না মারুফ সাহেব। লুবনা যে এরকম একটা কথা বলবে
তিনি তা কল্পনাও করেননি। প্রথম দু’মিনিট তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেননা। তবে তার সহজাত প্রবৃত্তি এবারো তাকে সাহায্য করলো। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলেন, কেন লুবনা এরকম একটা কথা বলবে। তার মনে হলো, এতোদিন সম্পর্কটা কন্টিনিউ করার কারণেই লুবনার মনে হয়েছে মারুফ সাহেবের উপর ওর একটা অধিকার তৈরী হয়েছে। এ কারণেই নিজের দেওয়া কমিটমেন্ট ভুলে গিয়ে কথাটা বলেছে ও।
খুব ঠান্ডা মাথায় ওকে বোঝাতে হবে, ভাবলেন তিনি।
‘লুবনা তুমি বোধহয় জানো না তুমি কি বলছো, শুনো...... ’
‘আমি ভালো করেই জানি কি বলছি আমি’ নির্বিকার গলা লুবনার।
এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন মারুফ সাহেব, বললেন-‘দেখো লুবনা, তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে দিন-রাত তড়পাচ্ছি আমি। সবসময় দারুন অপরাধবোধে ভুগছি । কারণ, একসাথে অনেকগুলো অপরাধ করেছি আমি। প্রথমত- নিজের নীতির বিরুদ্ধে গেছি, দ্বিতীয়ত- আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে বেঈমানি করেছি এবং সর্বোপরি তোমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছি । তবে দেরীতে হলেও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি আমি। তাই লুবনা, আমি চাই, আজই আমাদের এ সম্পর্কের অবসান হোক।’ একটানে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি।
এবার গম্ভীর হবার পালা লুবনার। বললো-‘তোমার কথা শেষ হয়েছে? এবার আমার কথা শোনো। তুমি হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই আমার সাথে নিজেকে জড়িয়েছো। কিন্তু আমি? আমার বেলায় ঠিক তার উল্টো। খুব ঠান্ডা মাথায়, প্ল্যান মাফিক তোমার সাথে এ সম্পর্ক গড়েছি আমি। শুরু থেকে এ পর্যন্ত
সবকিছুই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছে, এবং আমি নিশ্চিত বাকীটাও সেরকমই হবে। ওকি মারুফ, তোমার চেহারা এরকম পানসে হয়ে গেছে কেন? এখনো তো সবটা বলিনি আমি, আগে পুরোটা শুনো, তারপর নাহয় চিন্তা করো কি করবে।’
মারুফ সাহেবের এখনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছেনা কথাগুলো লুবনাই বলছে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে।
‘আমার এখনকার কথাগুলো শুনলে তুমি হয়তো ভাববে, এতো অল্পবয়সী একটা মেয়ের মাথা থেকে কি করে এরকম প্ল্যান বেরুলো কিংবা কি করে এতোটা নিচে নামতে পারলো। তবে মারুফ, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানলে তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’ একটু থামলো লুবনা, তারপর দম নিয়ে আবার শুরু করলো।
‘খুব সাধারণ একটা পরিবারে জন্ম আমার। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারাই আমি। কোনো অসুখে মারা যাননি তিনি। দিন-রাত মদ খেতেন এবং আমার মাকে মারধর করতেন। মারা যাবার একঘন্টা আগেও মদ খেয়েছেন তিনি। বাবা মারা যাবার সাত দিনের মাথায় মা তার পুরোনো প্রেমিকের সাথে চলে যান আমাকে ফেলে। আমার ঠাঁই হয় বাবার এক বন্ধুর ঘরে। না, করুণা কিংবা ভালোবাসার খাতিরে তিনি আমাকে আশ্রয় দেননি। বিনে পয়সায় বেশ ভালো একটা চাকরানি পেয়ে যায় তার বউ। মারুফ, এই মহিলার কাছ থেকেই শিখেছি আমি কি করে নির্মম হতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই আমার উপর নেমে আসতো তার অত্যাচারের খড়গ। তবে তার স্বামী, মানে আমার বাবার বন্ধু খুব একটা খারাপ ছিলেননা। অন্তত প্রথমদিকে তাই মনে হতো ।
এতোকিছুর মাঝেও পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিলো আমার। স্কুলে সবসময় প্রথম হতাম আমি। লোকটা বউয়ের কাছ থেকে চুরি করে আমাকে বই কিনে দিয়েছিলো। মাঝে মাঝে আমাকে পড়া দেখিয়ে দিতো।
বাবার কাছ থেকে আদর জিনিসটা পাইনি আমি। তাই মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য এই স্নেহকে বাবারই আদর মনে হতো। তবে পৃথিবীর মানুষের, বিশেষ করে পুরুষ মানুষের ভয়ংকর কুৎসিত রূপ তখনো দেখা হয়নি আমার। নিজের শরীরে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে চারপাশের মানুষের পরিবর্তনও চোখে পড়ে। এবং মারুফ, সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? সেই সব মানুষের মধ্যে ছিলেন আমার বাবার মতো সেই মানুষটাও। যে-হাতে তিনি আমাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন সেই হাতই প্রথম আমার সর্বনাশ করলো। তার বিকৃত লালসার শিকার হলাম আমি। এরপর আরো কয়েকবার লোকটা আমার উপর চড়াও হয়েছে। মুখ বুজে সহ্য করেছি , কারণ, এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা।
কিস্তু একদিন ঘটে গেলো বিপত্তি। বউয়ের কাছে ধরা পরে গেলো সে। তবে তাতে তার কোনো বিপদ হয়নি। কৌশলে সে সব দোষ চাপিয়ে দিলো আমার উপর। তার বউ নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করলো তার কথা।
তিনদিন আমাকে ঘরের ভিতর আটকে রাখা হলো। এই তিনদিন আমাকে উপোস রাখা হলো। ঘরের দরোজা বন্ধ করে কাপড়-চোপর খুলে মারতো আমাকে। চারদিনের দিন ওখান থেকে পালালাম আমি। যাবার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। মাঝে মাঝে আমাদের মতো মানুষদের নিয়ে টিভিতে যে প্রোগ্রাম দেখানো হতো সেগুলো দেখতাম আমি। সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম একটা মানবাধিকার সংগঠনের ঠিকানা। মানবাধিকার জিনিসটা তখনো পুরোপুরি বুঝতামনা আমি, তবে এটা জানতাম আমাদের মতো অত্যাচারিতদের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে ওরা। ওদের কাছে খুলে বললাম সব। মনে করেছিলাম অনেক কিছু করবে ওরা। ওদের বিরুদ্ধে মামলা-টামলা করবে, ওদের শাস্তি হবে।
কিন্তু তেমন কিছুই করেনি ওরা। তবে ওই সংগঠনে যাওয়াটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ ওখানকার এক নারী নেত্রী আমাকে তার বাসায় আশ্রয় দেন। উনি নিঃসন্তান ছিলেন। যে
কারণে আমাকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন। সন্তান না হওয়ার কারণ হিসেবে তার স্বামী তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যদিও দোষ ছিল ওর স্বামীরই। উনি আর বিয়ে করেননি। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, পুরুষ জাতির উপর তার ঘৃণা ধরে গেছে।
মারুফ, এই মহিলা যদি তার মমতার ছায়াতলে আমাকে আশ্রয় না দিতেন, তাহলে আমার ঠিকানা হতো রাস্তায়, নয়তো কোনো পতিতালয়ে। তার কাছ থেকে আমি সবকিছুই পেয়েছি। শহরের সবচেয়ে দামি স্কুলে পড়িয়েছেন। শিখিয়েছেন কিভাবে চলাফেরা করতে হয়।
তখন থেকেই আমি নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করতে শুরু করেছি। ওই মহিলার চেষ্টায় ফাইভ-স্টার হোটেলে রিসেপশনিস্ট এর চাকরি পাই আমি। আর সেখানেই দেশের বড় বড় হোমড়া-চোমড়ার দেখা পাই। খুব দ্রুত সরকারের এক মন্ত্রীর নজরে পড়ে যাই আমি। উনি প্রায়ই আসতেন এই হোটেলে। ফাঁদে আটকে ফেলি তাকে। এ ধরনের লোকেরা কচি মেয়েদের শরীর খুব পছন্দ করে। তাই তার কাছ থেকে যে সময় যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। এই যে এই অ্যাপার্টমেন্টটা, এটি তিনিই দিয়েছেন।
আরো অনেকেই আমার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে। কিন্তু মারুফ, এখন আমি ক্লান্ত। ভেবেছিলাম পুরুষদের নিয়ে এই খেলা ততোদিনই আমি চালিয়ে যাবো, যতোদিন আমার দেহে যৌবন থাকবে।’
ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক দুটোর ঘরে, তখন উঠে দাঁড়ালেন মারুফ সাহেব। দারোয়ান যখন তাকে গেইট খুলে দিল তখন তার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হলোনা যে, এতো রাতে তার সাহেব যাচ্ছেন কোথায়। কারণ
মাঝে মাঝেই সে তার সাহেবকে বাইরে যেতে দেখে। সে জানে তার সাহেব শুটিং এর কাজে বাইরে যান।
লুবনার বাসার সামনে গাড়ী থামালেন মারুফ সাহেব। সোডিয়াম লাইটের আলোয় বাড়ীর গেইট স্পষ্ট
দৃশ্যমান। অল্প একটু দুরে নিয়ে গাড়ী পার্ক করলেন তিনি। ছুরিটা পকেটে ভরলেন, তারপর নেমে গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। গেইট বন্ধ, তবে ওটা টপকে ভেতরে ঢুকতে মোটেই বেগ পেতে হলোনা তাকে। ভেতরে ঢোকার দরোজায় গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। মনে হচ্ছে দরোজা বন্ধ, এতো রাতে খোলা থাকার কথাও নয়। এই সমস্যার কথা মাথায় আসেনি তার। সমস্যাটা নিয়ে বেশীক্ষন ভাববার অবকাশ রইলোনা। কারণ হাতলে চাপ দিতেই খুলে গেলো দরোজা। মনে হয় বন্ধ করতে ভুলে গেছে লুবনা, ভাবলেন তিনি। লুবনার বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন মারুফ সাহেব। দরোজার দিকে চোখ পড়তেই আবারো কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো তার। কিন্তু এবারো তাকে অবাক হতে হলো, কারণ এই দরোজাও খোলা। আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। রুমের লাইট নেভানো, ঘর মোটামুটি অন্ধকার। তবে বেডসাইড ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেলো লুবনা শুয়ে আছে বিছানায়। মুখ দেখা যাচ্ছেনা, কারণ মুখের উপর চাদর ঢাকা। ঠিক এ সময় একটা শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। শব্দটার উৎস ধরতে পারলেন । বাথরুম থেকে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ শাওয়ার নিচ্ছে। কিন্তু লুবনা শুয়ে আছে বিছানায়, তাহলে বাথরুমে কে? একটু ভাবতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো মারুফ সাহেবের কাছে। বাথরুমে যে আছে সে লুবনার বেড-পার্টনার। তাকে রুমে ঢোকানোর পর সামনের দরোজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে ও। আর এখন লুবনার যেীবন সাগরে ডুব দেওয়ার পর বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছে ওই লোক। লুবনার রুমের বাথরুম এটাচড নয়, জানেন মারুফ সাহেব। ওই লোক বাথরুমে গেছে, এই কারণে বেডরুমের দরোজা খোলা। মারুফ সাহেবের মনে লুবনার উপর জমে থাকা ঘৃণার স্তুপটা আরো উঁচু হলো। মেয়ে লোকটা কি প্রতিরাতেই বিছানা শেয়ার করে? ভাবলেন তিনি। কিন্তু এই সব ছাইপাশ ভেবে সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই, ওই লোক রুমে ফেরার আগেই কাজ সারতে হবে।
পেশাদার খুনী কখনোই ছিলেননা মারুফ সাহেব। তবে এই মুহুর্তে একদম তাদের মতোই তার
আচরণ।
প্রথমে বেডসাইড ল্যাম্প অফ করলেন। কোনো কারণে লুবনা যদি জেগে যায়, তিনি চাননা তার চেহারাটা ও দেখুক। পকেট থেকে ছরিটা বের করলেন। কি ভেবে আবার সেটা ঢুকিয়ে রাখলেন। রক্তপাত ছাড়াই ঝামেলা এড়িয়ে খুব সহজে কাজটা করা যায়। লুবনার পাশে রাখা একটা বালিশ হাতে তুলে নিলেন তিনি। তারপর ওর চাদর ঢাকা মুখের উপর ওটা নামিয়ে এনে জোরে চেপে ধরলেন। ঘুমন্ত লুবনা অক্সিজেনের অভাবে হাঁস-ফাস করতে করতেই মারা গেলো। অন্ধকারে ওর মুখটা দেখতে পেলেননা মারুফ সাহেব, কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করলেন, লুবনার কোমল, সুন্দর মুখটা মৃত্যু-যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেলো। কাজটা শেষ করতে মাত্র আড়াই মিনিট সময় নিলেন তিনি। আর দু’ মিনিট সময় নিলেন
চাদর দিয়ে লাশটা বাঁধতে। কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত কাজটা শেষটা করলেন তিনি। এবং অবাক হলেন এই ভেবে, এতো কঠিন কাজটা এতো সহজে কিভাবে করলেন তিনি।
লাশটা বিছানা থেকে নামালেন মারুফ সাহেব। ভাবছেন বাথরুমে এতোক্ষন কি করছে লোকটা? যাই করুক, ও না আসায় কাজটা ঝামেলা ছাড়াই হয়ে গেলো।
পাঁজাকোলা করে লাশটা গাড়ীতে তুললেন তিনি। আগাগোড়া চাদর দিয়ে ঢাকা লুবনার ছোট্ট দেহটা খুব্ সহজেই বনেটের ভেতর জায়গা করে নিলো। গাড়ী ছেড়ে দিলেন মারুফ সাহেব।
শহরের ফাঁকা রাজপথ ধরে চলতে শুরু করলো গাড়ী। গন্তব্য- শহর ছেড়ে একটু দুরে একটা জায়গা, যেখানে মারুফ সাহেব একবার শুটিং এর জন্য গিয়েছিলেন। জায়গাটা বেশ নির্জন, তবে ছবির মতো সুন্দর। আর মারুফ সাহেব শুটিং এর জন্য সবসময় সেরকম জায়গাই বেছে নেন, যেখানে লোকজনের কোলাহল নেই।
মারুফ সাহেব ভাবছেন, এ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কেটেছে। এবার লাশটাকে পুঁতে ফেলতে পারলেই
ঝামেলা শেষ। কিন্তু তার ভাবনায় ছেদ পড়লো তখনই, যখন তিনি দেখলেন পুলিশের একটা টহল দল গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত তার মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেলো। ঘড়ি দেখলেন তিনি-দু’টো বেজে বত্রিশ। মাঝরাত পেরিয়ে প্রায় সকাল, এ সময় কোথায় যাওয়া হচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে কি জবাব দেবেন? রাত করে বেরুবার সময় এ ব্যাপারটা মাথায় আসেনি তার। এখন, একেবারে লাশ সমেত পুলিশের হাতে। চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। কিছুই মাথায় আসছেনা।
‘এই, গাড়ী থামাও!’ কথাটা কানে যেতেই নিজের অজান্তেই গাড়ী থামালেন মারুফ সাহেব।
বুড়োমতো একজন লোক, গালে দাড়ি, কাঁধে রাইফেল, বলল-‘এতো রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, অ্যাঁ’
মারুফ সাহেব রীতিমতো ঘামছেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুলনা। ‘এই, নামো, গাড়ী সার্চ করবো’। মারুফ সাহেবের ইচ্ছে হলো একছুটে গাড়ী চালিয়ে চলে যান, ঠিক এ সময় আবির্ভাব ঘটলো দ্বিতীয়জনের। নেমপ্লেট এবং ব্যাজ দেখলেন মারুফ সাহেব। তার নাম হাসিব এবং সে একজন এস. আই.। ‘কি হয়েছে আবদুল? দেখি’ বলে জানালার কাছে মুখ নামালো
এবং অবাক হয়ে বললো-‘ আরে স্যার, আপনি? এতো রাতে?’ তারপর অন্যদের উদ্দেশ্যে বললো-‘এই, সরে যাও, চেনোনি ওনাকে? মারুফ সাহেব, বিজ্ঞাপন বানান।’ আবার মারুফ সাহেবের কাছে গলা নামিয়ে
বললো ‘স্যার নিশ্চয়ই শুটিংয়ে যাচ্ছেন?’
‘জি,’ স্বস্তির সুবাতাস ততোক্ষনে বইতে শুরু করেছে মারুফ সাহেবের মনে।
‘কোথায়?’
‘এইতো, কাছেই।’
‘ও. কে. স্যার, যান আপনি।’
‘থ্যাংকস, ইন্সপেক্টর।’
‘ইটস মাই প্লেজার, স্যার।’ ওর মুখ দেখে মারুফ সাহেবের মনে হলো আসলেই কাজটা করতে পেরে নিজের উপর গর্ববোধ করছে সে।
আরেকটু হলেই গেছিলাম, ভাবছেন মারুফ সাহেব।
গাড়ী যখন শহরের রাজপথ ছেড়ে নির্জন রাস্তায় চলে এলো তখনই তিনি খেয়াল করলেন ব্যাপারটা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। কিন্তু এখন চাঁদ দেখার সময় নয়। যতো দ্রুত সম্ভব
এই ঝামেলা চুকিয়ে বাড়ী ফিরতে হবে।
গন্তব্যস্থানে পেীঁছে গেলো গাড়ী। জায়গাটা গাছ-পালা দিয়ে ভরা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, সেখানটা অনেকটা ফাঁকা। দ্রুত কোদাল আর শাবল নামিয়ে জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করলেন মারুফ সাহেব।
যখন তার মনে হলো পর্যাপ্ত জায়গা হয়েছে লাশটা পুঁতার জন্য, তখন থামলেন তিনি। বনেট খুলে লাশটা নামালেন। নিয়ে আসলেন গর্তটার কাছাকাছি। টেনে নামানোর কারণেই হোক আ অন্য কোনো কারণেই হোক লাশটার মুখের উপর থেকে চাদর সরে গিয়েছিলো ক্ষনিকের জন্য। টেনে গর্তে নামানোর সময়
লাশটার মুখের উপর চোখ পড়লো মারুফ সাহেবের, এবং দেখেই স্রেফ পাথর বনে গেলেন তিনি। বিশ্বাস করতে পারছেননা তার দেখায় ভুল নেই, প্রায় তিরিশ সেকেন্ড ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। আবার দেখার সাহস হলোনা, তবু আড়চোখে দেখলেন ।
পৃথিবীটা ঘুরতে শুরু করলো মারুফ সাহেবের, মনে হলো চেরাবালিতে দেবে যাচ্ছেন তিনি। এ কার মুখ দেখছেন তিনি! কাকে খুন করেছেন নিজের হাতে! এ যে তার অতি আদরের মেয়ে ফারাহ!
কি করে হলো, কেমন করে হলো এই ভুল, সেটা ভাববার অবকাশ রইলোনা তার, কারণ জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছেন তিনি মেয়ের লাশের উপর।
মারুফ সাহেবের জানার কথা নয়-দু’বার তার অবর্তমানে তার বাসায় গিয়েছিলো লুবনা। সেই সময় ফারাহর সাথে পরিচয় হয় তার। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে ঘনিষ্টতা বাড়ে ওদের মধ্যে। এর মধ্যে
একবার বাবাকে বলেছিলো ফারাহ তাদের এই বন্ধুত্বের কথা। মারুফ সাহেব শুনেছিলেন এবং ভুলেও
গিয়ে ছিলেন। গত রাতে তিনি যখন প্ল্যান করছিলেন কি করে লুবনাকে খুন করবেন, তখন ফারাহ বাবাকে বলেছিলো যে, সে লুবনার বাসায় যাচ্ছে। মারুফ সাহেব খেয়াল করেননি। ফোনে যখন
ফারাহ বলছিলো সে ফিরছেনা, তখনও তিনি জানতে চাননি কেন ফিরছেনা, কোথায় থাকছে, এসব।
কারণ তখনও তিনি গলদঘর্ম হচ্ছেন লুবনার ব্যাপারটা নিয়ে।
দরোজা খুলে লুবনা কোনো বেড-পার্টনারকে ঢুকায়নি, ঢুকিয়েছিলো ফারাহকে। লুবনা ভেবে মারুফ সাহেব যখন নিজের হাতে খুন করছিলেন নিজের মেয়েকে, তখন বাথরুমে ছিলো লুবনাই। আর সে ফাঁকেই ঘটে যায় এই ট্রাজেডি।
মেয়ের লাশের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন মারুফ সাহেব। একটা শকুন চক্কর দিচ্ছে আকাশে। চাঁদের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দুটো দেহ পরে রয়েছে নিথর এবং নিস্তব্দ।
সে জানে দুটো দেহের মধ্যে একটা জীবিত। তাই ইচ্ছে থাকলেও নিচে নামতে পারছেনা সে।
শেষ
No comments:
Post a Comment